Press "Enter" to skip to content

সংশোধনাগারে বন্দীরা কি মানসিক রোগ বাইপোলার ডিজ অর্ডারে ভুগছেন?

Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা,২২মার্চ ২০২০ মাত্র ১৯দিনের ব্যবধানে রাজ্যের দুই সংশোধনাগারে ঘটলো মারাত্বক ঘটনা। বন্দী বিদ্রোহ। ২মার্চ দক্ষিণ ২৪ পরগণার বারুইপুর জেলে কয়েকজন আধিকারিকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বন্দীরা বিক্ষোভ দেখান। সেই বিক্ষোভকে সামাল দিতে নাস্তানাবুদ হতে হয় কারারক্ষী ও পুলিশকর্মীদের। সেই ঘটনার আগাম আঁচ নিতে যেমন ব্যর্থ হন বারুইপুর সংশোধনাগারে আধিকারিকেরা, ঠিক তেমনই কলকাতার দমদম সংশোধনাগারের আধিকারিকেরাও বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন।

২১মার্চ বেলা বাড়তেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন দমদম জেলের সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন বন্দীরা।করোনা ভাইরাস রুখতে প্রশাসনিক নির্দেশ মেনে বন্দীদের সঙ্গে তাদের বাড়ির লোকেদের দেখাসাক্ষাৎ সাময়িক বন্ধ করা হয়। এদিনের ঘটনার প্রেক্ষিতে কারামন্ত্রী জানান, বন্দীরা করোনা ভাইরাসের কারণে প্যারোলে মুক্তির আর্জি জানান। সেই বিষয়ে প্রশাসন এক তালিকা বানায় জেলে বন্দীদের আনুগত্যের ভিত্তিতে। বাকি বন্দীরা সেই নির্বাচন পক্ষপাত দুষ্ট বলে জেলের ক্যান্টিন ও অফিসে আগুন ধরিয়ে দেয়। জেলের ভিতরের ভিডিও দেখে পুলিশকর্তারা অনুমান করছেন, যেভাবে বন্দীরা মারমুখী হন , তা রীতিমতো পরিকল্পনামাফিক। প্রায় তিন হাজার বন্দীকে সামাল দিতে বিরাট পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ও গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি চালানোর কথা অস্বীকার করা হয়।আহত বন্দী বিজয় দাস বলেছেন, পুলিশের গুলিতে বহু বন্দী মারা গেছে। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে কোথাও এক কোথাও চার জন বন্দীর মৃত্যুর কথা বলা হয়েছে। বন্দীদের হামলায় আহত হন ডি জি কারা অরুণ গুপ্ত সহ পাঁচ কারাকর্মী।

হাসপাতালে সব মিলিয়ে ২৮জন ভর্তি। অন্য সূত্র বলছে, আহতের সংখ্যা প্রায় ৫০। প্রশাসন সূত্রের খবর, ৩১মার্চ পর্যন্ত আদালতে কাজ হবে জরুরি ভিত্তিতে। ফলে জামিনের মামলা হবে না। এই নিয়ে ক্ষোভ বিচারাধীন বন্দীদের। তার ওপর করোনা রোধ করতে কারা দফতর থেকে বাড়ির লোকেদের সঙ্গে বন্দীদের দেখা করা বন্ধ করায় আগুনে ঘি পড়ে। কেন বন্দীরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছেন, আর কেনই বা কারাগারের আধিকারিকেরা বন্দীদের ক্ষোভের আঁচ পান না তা চিন্তার বিষয়।
তদানীন্তন জেলখানা পরিমার্জিত ভাষায় বলা হচ্ছে সংশোধনাগার। রাজ্যে কেন্দ্রীয় সংশোধনাগার, জেলা সংশোধনাগার ও কিছু উপ সংশোধনাগার আছে। নামে যতই পরিবর্তন ঘটানো হোক জেল থেকে গেছে সেই দুর্নীতির আখড়া। দায়ী কিছু অসাধু আধিকারিক ও নিচুতলার কর্মী। জেলের ভেতর ও বাইরের গ্রুপিজম মূলত ইন্ধন দেয়। অথচ কারা দফতরের হোমরাচোমরারা সব জেনেও চোখ বুঝে থাকেন।ফলে আগামীদিনে রাজ্যের কারাগারগুলোতে আরও বড় ধরনের ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
মনে রাখা দরকার, প্রাথমিকভাবে আইনের চোখে বন্দী যতক্ষণ না অপরাধী ঘোষিত হচ্ছেন ততদিন কারাগারে বন্দীকে রাখা হয় মানসিক পরিবর্তন বা নিরাপত্তার স্বার্থে। অস্বীকার করার উপায় নেই সংশোধনাগারের প্রশাসনিক স্তরের আধিকারিকেরা এক শ্রেণীর দীর্ঘমে়য়াদি সাজাপ্রাপ্ত বন্দীদের দিয়ে সাধারণ বন্দীদের ওপর অত্যাচার চালান। তাদের সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নিয়ে নানা আর্থিক টোপের শিকার বানানো হয়। যদি বন্দী টাকা দিতে পারে তবে তাদের একটু স্বচ্ছন্দভাবে থাকতে দেওয়া হয়। নাহলে পায়খানা বাথরুমের পাশে তাদের শুতে দেওয়া হয়। পেটোয়া বন্দীরা টাকা আদায় করে ভাগ পাঠায় জেল প্রশাসনের বাবুদের কাছে। বিশেষ পছন্দের খাদ্য বা নেশার বস্তুও দেওয়া হয় চড়া দামে।এছাড়া দীর্ঘদিন জেলে কাটানোর জন্য সাজাপ্রাপ্ত বন্দীরা তাদের যৌন তৃপ্তি মেটাতে বিচারাধীন কমবয়সী দের বাধ্য করে। এই ক্ষেত্রেও যারা এই অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে চান, টাকা দিতে পারলে ছাড় দেওয়া হয়। টাকা না দিলে এঁটো বাসন মাজানো, বডি ম্যাসেজ করানোও হয়। টাকা দিলে সিমসহ মোবাইলেরও ব্যবস্থা হয়। যদিও ২০১৮সালে ২২জুলাই বিধানসভায় দি ওয়েস্ট বেঙ্গল কারেকশন সার্ভিসেস (আমেন্ডমেন্ট)বিল ২০১৮ পাশ হয়।যেখানে বন্দী থেকে কারাগারের সবস্তরের কর্মীদের ও বন্দীদের কাছে বেআইনি মোবাইল ফোন পেলে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তিন বছরের কারাদণ্ড হবে বলা হয়।তবে সর্ষের মধ্যে ভূত আছে বলেই এখনও বন্দীদের কাছে মোবাইল ফোন মেলে। তবে সংখ্যাটা কমেছে। ফলে দরও বেড়েছে।
মনোরোগ বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, অপরাধীরা মানসিক স্থিতি হারিয়েই অপরাধ করেন। এর মধ্যে ধনী, দরিদ্র,মধ্যবিত্তরাও আছেন। জেলে চার দেওয়ালের মধ্যে থাকতে থাকতে মানসিক চাপে ভোগেন। ফলে মস্তিষ্কের গঠনগত ও কার্যগত ত্রুটি ঘটে। বিজ্ঞান বিষয়টিকে বায়োলজিকাল সাইক্রিয়াটিক
কভানেটি নিউরোসাইন্স অ্যান্ড নিউরোইমেজিং পদ্ধতির সাহায্যে মস্তিষ্কে ক্ষয় মান কার্যকারিতা ও কর্টিক্যাল থিকনেস বা বাইপোলার ডিজঅর্ডারকে দায়ী করছে। গবেষণায় গঠনগত ও কার্যকরী এম আর আই ডাটার মধ্যে সম্পর্ক খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তনু যোশী ও তাঁর সহযোগী গবেষকেরা মস্তিষ্কের যে অংশটি মানুষের মুড কে নিয়ন্ত্রন করে, সেই অংশটিতে মনোনিবেশ করে মুড ডিজঅর্ডারের কারণ খুঁজেছেন। গবেষণায় বলা হয়েছে, অস্বাস্থ্যকর খাদ্য, একাকিত্ব,বাসস্থানের অভাব, সামাজিক অবহেলা, যৌনতার অভাব ও মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতার অভাবও কিছুটা দায়ী।ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, এই মানসিক রোগে আক্রান্ত মানুষেরা শারীরিক ও মানসিক লাঞ্ছনার শিকার বেশি হন। এই রোগ বিশ্ব জুড়ে। প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিজের অনিচ্ছাকৃত ক্ষতি সাধন, হিংসা এর একটি লক্ষণ।

এই রোগীদের মুড ডিজঅর্ডারের বা ম্যানিয়াক ডিপ্রেসন মুড লেভেল, এনার্জি লেভেল ও এক্টিভিটি লেভেল এ ঘনঘন পরিবর্তন হয়। এই রোগে মধুমেহ, হৃদরোগে মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে।
চিকিৎসকেরা এই ধরণের রোগীদের লিথিয়াম, ভেল পরেট ওলাজাপিন কিম্বা কুইটিয়াপাইন গোত্রের ওষুধ দেন। বিদেশে নিয়মিত এই বিষয়টিতে লক্ষ্য রাখেন মনোবিদরা। আমাদের দেশে মনোরোগ বিষয়টিতে প্রশাসন ও নাগরিক সচেতনতা অনেক কম। ফলে সংশোধনাগারে বন্দী বিদ্রোহের ঘটনা বাড়বে বৈ কমবে না। তাই প্রশাসনের আধিকারিক ও কারা কর্মীদের যেমন মনস্তত্ত্বের পাঠ দেওয়া দরকার, পাশাপাশি জেল দায়িত্বে থাকা আধিকারিক ও কর্মীদের অসাধুপ্রবণতার দিকে কঠোর নজর রাখতে হবে।প্রশাসনিক স্তরের সঙ্গে কারাকর্মীদের সংগঠনেরও সার্বিক দায়িত্ব বর্তায় ।

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.