জন্মদিনে স্মরণঃ সু কু মা র সে ন
বাবলু ভট্টাচার্য : তরুণ অধ্যাপক ছেলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস শেষ করে বর্ধমানের বাড়ি এসেছেন। ঘরে ঢুকেই দেখেন সামনে বাবা দাঁড়িয়ে। অধ্যাপক ছেলেটি তাঁর লেখা সাধের বই ‘হিস্ট্রি অফ ব্রজবুলি লিটারেচার’ বের করে বাড়িয়ে ধরলেন বাবার দিকে।
ছেলে প্রতীক্ষায়, বাবা কী বলেন। উল্টেপাল্টে বইটি দেখলেন বাবা। ছেলেকে বইটি ফেরত দিয়ে বললেন- ‘চৈতন্যদেবকে নিয়ে ব্যবসা কোরো না।’
না, তিনি ব্যবসা করেননি, আত্মস্থ করেছিলেন। তাই বোধহয় শোনা যেত তাঁর সিদ্ধান্ত, ‘চৈতন্যদেব শ্রেষ্ঠ বাঙালি’। সে দিনের তরুণ অধ্যাপক সুকুমার সেন। আর বইটি দিয়েছিলেন তাঁর বাবা হরেন্দ্রনাথ সেনকে।
সুকুমার সেনের বাবা হরেন্দ্রনাথ সেন ছিলেন বর্ধমান কোর্টের আইনজীবী ও মা নলিনী দেবী গৃহিণী। বর্ধমান জেলার গোতান গ্রামে ছিল তার পৈত্রিক নিবাস। ওখানেই সুকুমার সেনের পড়াশোনার শুরু। ১৯১৭ সালে বর্ধমান মিউনিসিপ্যাল হাইস্কুল থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা এবং ১৯১৯ সালে বর্ধমান রাজ কলেজ থেকে বাংলা, সংস্কৃত, লজিক ও গণিতে লেটারসহ প্রথম বিভাগে আইএ পাস করেন।
১৯২১ সালে কলকাতার সংস্কৃত কলেজ থেকে সংস্কৃতে সম্মানিসহ প্রথম বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে বিএ পাস করেন। ১৯২৩ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্বে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম স্থান অধিকার করে এমএ উত্তীর্ণ হন।
সুকুমার সেন ১৯২৫ সালে ‘সিনট্যাক্স অব বৈদিক প্রোজ’ নামে থিসিস লিখে প্রেমচাঁদ-রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। ১৯২৬ সালে তাঁর প্রথম গবেষণা প্রবন্ধ ‘নোটস অব দ্য ইউজ অব কেসেস ইন দ্য কথক সংহিতা’ প্রকাশিত হয় এশিয়াটিক সোসাইটি জার্নালে। এরপর মধ্য ও আধুনিক (বাংলা) আর্যভাষার ঐতিহাসিক পদবিচারের উপর গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন।
সুকুমার সেন মিথ-আশ্রিত ভাষাতত্ত্ব বা পুরাণচর্চার পরিবর্তে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করতেন। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ, এশিয়াটিক সোসাইটি ও বর্ধমান সাহিত্য সভার প্রায় ১২ হাজার পুঁথি পরীক্ষা করেন। জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দম’ কাব্যের প্রাচীন পুঁথিটি তাঁরই আবিষ্কার। ‘সেকশুভোদয়া’ পুঁথিটিও তিনি সম্পাদনা করেন।
তাঁর উল্লেখযোগ্য বইয়ের মধ্যে রয়েছেঃ ‘ভাষার ইতিবৃত্ত’, ‘বাংলা স্থাননাম’, ‘রামকথার প্রাক-ইতিহাস’, ‘ভারত-কথার গ্রন্থিমোচন’, ‘বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘বঙ্গভূমিকা’, ‘ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস’, ‘Women’s Dialect in Bengali’ ও ‘A History of Brajabuli Literature’.
ভাষাতত্ত্ব ও পুরাণ ছাড়া রবীন্দ্রসাহিত্যেও সুকুমার সেনের বিশেষ প্রজ্ঞা ছিল। তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য ব্যাখ্যাতা ও রসজ্ঞ।
সুকুমার সেন ১৯৬৪ সালে ‘ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস’ বইটির জন্য রবীন্দ্র পুরস্কার পান। এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে ‘যদুনাথ সরকার পদক’ দিয়ে সম্মানিত করে। রবীন্দ্রচর্চা কেন্দ্র থেকে পান ‘রবীন্দ্র তত্ত্বাচার্য’ উপাধি।
ভারতীয় ভাষাতাত্ত্বিক ও সাহিত্য বিশারদ সুকুমার সেন ১৯৯২ সালের ৩ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।
সুকুমার সেন ১৯০০ সালের আজকের দিনে (১৬ জানুয়ারি) পূর্ব বর্ধমানের গোতান গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment