সঙ্গীতা চৌধুরী: কলকাতা, ২৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১। এ বছরের দুর্গোৎসবেও মাস্ক, স্যানিটাইজার এবং অন্যান্য যাবতীয় কোভিভ- বিধি মানার বাধ্যবাধকতা থাকছে বলে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে ইতিমধ্যে জানানো হয়েছে । তবে এইবার আর নতুন করে কোন ঘোষণা করা হয় নি। গত বছর যে সব কোভিভ প্রোটোকল মেনে পুজো হয়েছে এবারও সেভাবেই হবে। রাজ্য সরকার থেকে এখনও অবধি সেরকম আশ্বাসই দেওয়া হয়েছে ।

গত বছর তৃতীয়ার দিন হাইকোর্টের নির্দেশিকা অনুযায়ী পুজোর মন্ডপে দর্শকদের প্রবেশাধিকার ছিল না। এই বছর করোনা সংক্রমণ এখনো পর্য্যন্ত অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে , তা সত্ত্বেও কলকাতার পুজো মণ্ডপগুলিতে কি শেষ পর্যন্ত ভিড় করে ঠাকুর দেখার অনুমতি মিলবে! সে ব্যাপারে অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।

তাই এ বার অনেক পুজোর উদ্যোক্তাই তাদের মন্ডপের পরিকল্পনা এমন ভাবে করছেন যাতে বাইরে থেকেই প্রতিমা দর্শন করা যায়। আগের বছরের সব নির্দেশিকা অনুযায়ী এবারও পুজোর ব্যবস্থাপনার দিকে সবাই এগোচ্ছে। বিভিন্ন পুজো কমিটি এবং বাড়ির পুজোর উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে সেরকমই ইঙ্গিত মিলল।
‘বাদামতলা আষাঢ় সংঘ’- এর সাধারণ সম্পাদক সন্দীপ চক্রবর্তী জানালেন, ” আমরা আগের বছর অতিমারির সময়ই পরিকল্পনা করে ড্রাইভ – ইন দর্শন ব্যবস্থা চালু করি। তাই গতবছর শেষ মুহূর্তে হাইকোর্টের নির্দেশিকায় আমাদের কোন অসুবিধা হয় নি। আমরা এ বছরও ড্রাইভ – ইন দর্শন ব্যবস্থা চালু রাখছি । কারন এই অভিনব ব্যবস্থা খুবই সাফল্যমণ্ডিত হয়েছিল। বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতিতে আমরা সারা বিশ্বের সামনে একটা নির্দশন তৈরি করেছিলাম। তবে এইবারের বিশেষ ব্যবস্থা হলো পুজো কমিটির সব মেম্বারদের এবং আমাদের পুজোর সঙ্গে জড়িত পুরোহিত, ঢাকি, যারা প্যান্ডেল বানাচ্ছেন আর সাথে যারা আছেন সবাইকে দুটো ভ্যাকসিনই পুজোর আগেই দিয়ে দেওয়া।”
‘বালিগঞ্জ কালচারাল’-এর সাধারণ সম্পাদক অঞ্জন উকিল বলেন, ” আমরা এবার গত বছরের মতোই সব নির্দেশিকা মানছি, এবারের পুজোর বাজেট অনেকটাই কম হচ্ছে। তবে এবার প্যান্ডেল পুরোই খোলা থাকবে যাতে অনেক দূর থেকেও দর্শকরা প্রতিমা দর্শন করতে পারেন। সব থেকে বড় ব্যাপার হলো দর্শকরা চাইলে গাড়ি করেও আমাদের প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন। আর গত বছরের মতোই প্যান্ডেলে প্রবেশের জন্য মাস্ক ও স্যানিটাইজার ব্যবহার করতে হবে।”

‘ শিব মন্দিরের ‘পার্থ ঘোষের মুখেও একই কথা শোনা গেল যে, তারাও মন্ডপের বাইরে থেকেই প্রতিমা দর্শনের ব্যবস্থা করেছেন । তবে মাস্ক ছাড়া কোন দর্শকই ভেতরে ঢোকার অনুমতি পাবেন না। গতবারের মতো স্যানিটাইজার ও রাখা থাকবে পুজো মণ্ডপে। তবে পরিস্থিতি ঠিক থাকলে রাজ্য সরকার থেকে অনুমতি মিললে আঠারো তারিখ কার্নিভালের ব্যবস্থা হবে।

‘হাতিবাগান দুর্গোৎসব ‘কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাশ্বত বসুর কথায়, “এবার পুজো প্যান্ডেল পুরো খোলামেলা হবে। মূল মণ্ডপ ছাড়া ওপরের দিকও খোলা থাকবে। পুষ্পাঞ্জলি, প্রসাদ বিতরণ সবই নির্দিষ্ট দূরত্ব – বিধি বজায় রেখে করা হবে। তাছাড়া পুজোর সঙ্গে জড়িত সবার ভ্যাকসিনেশনের দিকটাও দেখা হচ্ছে । গত বছরের নির্দেশিকা অনুযায়ী এবার সমগ্র পুজোর পরিকল্পনা করা হয়েছে । তবে দুটো ব্যাপারে অনিশ্চয়তার মধ্যে রয়েছি সেটা হল, প্রতিমা ভাসানের আগে কার্নিভাল আর নাইট কার্ফু। পুজোর সময় নাইট কার্ফু চালু থাকলে, দর্শকরা রাত জেগে ঠাকুর দেখতে পারবেন না। ”

‘ভারত চক্র ‘ – পুজো কমিটির সাধারণ সম্পাদক প্রতীক চৌধুরী জানালেন, ” এবার আমাদের প্যান্ডেল কৃষক আন্দোলনের ওপর হচ্ছে। আমাদের মূল মন্ডপে প্রতিমার থেকে পঁয়তাল্লিশ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে দর্শকরা যাতে বাইরে থেকেই প্রতিমা দর্শন করতে পারেন সেরকম ব্যবস্থা করা হয়েছে। তারপর তারা দুই দিক দিয়ে বেরিয়ে যাবেন । তাছাড়া প্যান্ডেলে ঢোকার আগে সবাইকে স্যানিটাইজ করা হবে। এই ভাবে আগের বছরের সব নির্দেশিকা মেনেই আমরা এ বছরের দুর্গোৎসব পালনের দিকে এগোচ্ছি ।”
শুধু বিভিন্ন পুজো কমিটি যে নিয়ম মেনে এগোচ্ছে তাই নয়, বাড়ির পুজোতেও মানা হচ্ছে কোভিভ বিধি – নিষেধ। রাণী রাসমণির বাড়ির এ বছরের পুজোও গত বারের মতো রাজ্য সরকারের নির্দেশিকা মেনেই হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাড়ির সদস্য এবং পুজোর অন্যতম আয়োজক প্রসূন হাজরা। তিনি বলেন, ” আমাদের পুজো দেখতে অনেক দূর দূর থেকেও দর্শকরা আসেন। গত বার থেকেই সেটা বন্ধ আছে। এ বারও পুজোয় সীমিত সংখ্যক নিমন্ত্রিতই থাকবেন। সবাইকে স্যানিটাইজ করে ভেতরে প্রবেশ করানো হবে। তবে ঠাকুর দালানে শুধুই বাড়ির সদস্য এবং আত্মীয়- স্বজনদের প্রবেশাধিকার থাকবে। নিমন্ত্রিতরা বাড়ির উঠোন থেকেই প্রতিমা দর্শন করবেন। পুজোর ক’দিন বাড়ির বাচ্চাদের খুবই সাবধানে রাখা হবে। আগের বার আমরা পুষ্পাঞ্জলিতে করোনা অতিমারী সংক্রমণের ভয়ে ফুল ব্যবহার করিনি। কিন্তু এবার করবো বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমাদের পুষ্পাঞ্জলি কেউ চাইলে ডিজিটাল মাধ্যমেই দিতে পারবেন, সেরকম ব্যবস্থা থাকবে। পুজোর বিশেষ বিশেষ মুহূর্তগুলো লাইভ টেলিকাস্ট হবে। ”
শোভাবাজার রাজবাড়ির সদস্য এবং পুজোর আয়োজক সৌমিত নারায়ন দেবের কথায়, ” আগের বারের মতো এবারও আমাদের বাড়ির পুজোর প্রবেশ দ্বারে স্যানিটাইজেশন মেশিন বসবে। সবাইকে মাস্ক পড়ে প্রবেশ করতে হবে এবং শরীরের তাপমাত্রা চেক করা হবে। আমাদের পুজোয় সবার জন্য অবারিত দ্বার থাকবে । সেই ১৭৫৭ সাল থেকে আমাদের পুজো শুরু হয়। তখন মাত্র দুটো পুজো হয়েছিল, শোভাবাজার রাজবাড়ির পুজো আর কৃষ্ণ নগরে রাজা কৃষ্ণ চন্দ্রের পুজো। তখন থেকেই পুজোর সময় সবার জন্য দরজা খুলে দেওয়া হয় । সেই ধারাই অব্যাহত থাকবে । তবে বর্তমান অতিমারি পরিস্থিতিতে দর্শকরা শুধু কিছু বিধিনিষেধ মেনেই শোভাবাজার রাজ বাড়ির প্রতিমা দর্শন করতে পারবেন।”
দেখতে দেখতে আমরা দুর্গোৎসবের প্রায় দোরগোড়ায় এসে দাঁড়িয়েছি। আশ্বিন মাসের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে আছি বৃষ্টি ও নিম্নচাপের প্রকোপ আজও কমেনি। এই লাগামছাড়া বৃষ্টির জন্য মূর্তি তৈরি থেকে মণ্ডপ এমন কি পুজোর কেনাকাটার ক্ষেত্রেও বাধা সৃষ্টি হয়েছে। সকলের মনে ভয় এই প্রবল বৃষ্টি পুজোর আনন্দ মাটি করে দেবে না তো! এর সাথে আছে করোনা অতিমারীর তৃতীয় ঢেউ এর আতঙ্ক। এখন দেখা যাক, সংক্রমণের এই দ্বিতীয় বর্ষের পুজো শেষ পর্যন্ত কিভাবে উৎযাপিত হয় !
Be First to Comment