“মানুষের অবক্ষয় আমাকে আকর্ষণ করে। তার কারণ এর মধ্য দিয়ে আমি দেখি জীবনের গতিকে, স্বাস্থ্যকে। আমি বিশ্বাস করি জীবনের প্রবহমানতায়। আমার ছবির চরিত্ররা চিৎকার করে বলে আমাকে বাঁচতে দাও। মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েও সে বাঁচতে চায়— এ তো মৃত্যু নয়, জীবনেরই জয় ঘোষণা।”
———— ঋত্বিক ঘটক
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, প্রবল বেঁচে থাকার তাড়না নিয়ে দাদাকে চিৎকার করে নীতা বলেছিল, “দাদা, আমি বাঁচতে চাই দাদা।” পাহাড়ে ইকো হয়ে বারবার ফিরে আসছিল বোনের সেই আকুতি। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে যে সংলাপ অমর হয়ে আছে। ঋত্বিক ঘটক জাদু জানতেন। জানতেন বলেই অভিনেতা- অভিনেত্রীদের ব্যবহার করে জাত চেনাতে থাকতেন বারবার। বিংশ শতকের পাঁচের দশকে কলকাতার এক বাঙালি পরিবার ঘিরে ‘মেঘে ঢাকা তারা’ কাহিনির আবর্তন। ১৯৪৭-এর দেশভাগের পর এই শরণার্থী পরিবার আশ্রয় নেয় কলকাতা শহরের বিভিন্ন প্রান্তে। ছবির মূল চরিত্র নীতা, পরিবারের বড়ো মেয়ে। পড়াশোনার পাঠ চুকানোর আগেই পরিবারের হাল ধরতে হয় তাকে। নীতার বৃদ্ধ বাবা স্কুলে পড়ায়। আর মা ঘরবাড়ি দেখাশোনা করে।
নীতার চূড়ান্ত অসুস্থতা নজরে পড়ে তার দাদার। পাহাড়ের ওপর হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় নীতাকে। জীবন-মৃত্যুর দোলাচলে এসে, শংকরকে (দাদাকে) জানায়, সে বাঁচতে চায়। আকাশে, পাহাড়ের গায়ে প্রতিধ্বনি হয় নীতার আকুতি। সুপ্রিয়া হয়ে উঠলেন জীবন্ত নীতা। বাঙালি আর ভুলতে পারল না তাঁকে। ১৯৬০ সালের আজকের দিনে (১৪ এপ্রিল) মুক্তি পায় ভারত-পাকিস্তান বিভাজনের প্রেক্ষাপটে নির্মিত বাংলা চলচ্চিত্র “মেঘে ঢাকা তারা”। এটি ছিল ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত চতুর্থ এবং প্রথম ব্যবসা সফল চলচ্চিত্র। শক্তিপদ রাজগুরুর মূল কাহিনি অবলম্বনে চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখেন মৃণাল সেন। অভিনয়ে ছিলেন, সুপ্রিয়া চৌধুরী, অনিল চট্টোপাধ্যায়, নিরঞ্জন রায়, গীতা ঘটক, বিজন ভট্টাচার্য, গীতা দে, দ্বিজু ভাওয়াল, জ্ঞানেশ মুখার্জী, রনেন রায়চৌধুরী প্রমুখ।
ভারতে অঁতর ধারার নিরীক্ষাধর্মী চলচ্চিত্রে ঋত্বিক ঘটকের আটটি চলচ্চিত্রের মধ্যে “মেঘে ঢাকা তারা” সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও আলোচিত। ঋত্বিক মারা যাবার পর, এ ছবিসহ তার অন্যান্য কাজ বিশ্বের চলচ্চিত্র দর্শকদের কাছে বেশি পরিচিতি পায়। সাইট অ্যান্ড সাউন্ড চলচ্চিত্র বিষয়ক মাসিক সাময়িকীতে সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রের তালিকায় “মেঘে ঢাকা তারা” ২৩১ নম্বরে অবস্থান করে নেয়।এই ছায়াছবিতে ঋত্বিক শব্দ ও সুর নিয়ে অনেক পরীক্ষা- নিরীক্ষা করেছেন। দক্ষিণী রাগ ‘হংসধ্বনি’ এবং এই বিশেষ রাগভিত্তিক খেয়াল তিনি ব্যবহার করেন সিনেমার আবহ সংগীত হিসেবে। আরও উল্লেখ্য হচ্ছে, ঋত্বিক প্রথমবারের মতো রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করেন এই ছবিতে। এ ছাড়াও অনিবার্যভাবে বাংলাদেশের লোকসংগীতের বিশেষ ব্যবহার লক্ষ করা যায় ছবিটিতে। সংলাপে ঋত্বিক কারুণ্য ও যন্ত্রণাকে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছিলেন। অতিনাটকীয়তাকে ধারণ করেও ছবির বক্তব্য ও ভাবরসের সঙ্গে মিলেমিশে এর সংলাপ বাংলা চলচ্চিত্র জগতের এক অমূল্য সম্পদ। সবমিলিয়ে বাংলা সিনেমার ইতিহাসে ‘পথের পাঁচালী’-র পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ চর্চিত এই সিনেমাটি দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ধ্রুপদী সিনেমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে।
‘মেঘে ঢাকা তারা’ একই সঙ্গে একটা গোটা জাতির কথা বলে, আবার মানুষের ব্যক্তিগত কথকতাকেও ধারণ করে থাকে। ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে আমরা নিজেদের মতো এর ব্যক্তিগত বয়ান তৈরি করতে পারি নিজস্ব অনুভূতি মিলিয়ে। আমাদের প্রত্যেক ভাঙনের মুখে, বিপর্যয়ের মুখে এই ছায়াছবির বিশেষ কিছু চিত্রকল্প আজও স্পর্শযোগ্য হয়ে ওঠে। একজন চলচ্চিত্রনির্মাতার কাছে এর চেয়ে বড়ো সার্থকতা আর কী-ই বা হতে পারে?
Be First to Comment