স্মরণ : মো হা ম্ম দ র ফি
বাবলু ভট্টাচার্য : এখনো দিল্লি কিংবা মুম্বাই অথবা কলকাতার পান দোকান থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্তোরাঁয়, খাবারের দোকানে কিংবা রাস্তায় চলা অসংখ্য ট্যাক্সিতে ভালোবাসায় প্রতিদিন বেজে ওঠেন মোহাম্মদ রফি৷ তিনি কখনো পুরোনো হওয়ার নন। ফুরিয়ে যাওয়ার নন।
‘বাহারো ফুল বরসাও’, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহফিল’, ‘গুলাবি আঁখে’- এমনি কত সহস্র গান, কত সুপারহিট ছবি! রফি সাহাবের কণ্ঠে গান মানেই তো সেটি শ্রোতার হৃদয়ে স্থান পাবে। কিংবদন্তি এই প্লেব্যাক গায়ক প্রায় ২৮ হাজার গান গেয়েছিলেন।
রফি সাহাব হিন্দি ছাড়াও বাংলা, অহমিয়া, উড়িয়া, কোনকানি, ভোজপুরি, পাঞ্জাবি, মারাঠি, সিন্ধি, কন্নাড়া, গুজরাটি, তেলেগু, মাগাহি, মৈথিলি, উর্দু ইত্যাদি ভারতীয় ভাষায় গান গেয়েছেন। ইংরেজি, ফার্সি, স্প্যানিশ এং ডাচ ভাষাতেও গান করেছেন।
অমৃতসরের কাছে একটি ছোট গ্রাম কোটলা সুলতান সিং। সেই গ্রামে ১৯২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর হাজি আলি মোহাম্মাদের সন্তান রফি সাহাব জন্মগ্রহণ করেন।
১৯৪৪ সালে প্রথম বারের মতো নওশাদের সংগীত পরিচালনায় গান করেন রফি সাহাব। আর এর মাধ্যমেই শুরু হয় নওশাদ-রফির পথচলা। এই জুটি উপহার দিয়েছেন অসাধারণ সব গান।
‘লায়লা মজনু’, ‘শাহজাহান’, ‘জুগনু’, ‘কাশ্মির কি কলি’- একের পর এক ছবিতে গান করেন রফিজি। কে এল সায়গল, নূরজাহানের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের সঙ্গে সে সময় গান করেছেন তিনি।
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে বলিউডে রফি ছিলেন ব্যস্ততম প্লেব্যাক গায়ক। সে সময়ের নামকরা সংগীত পরিচালক নওশাদ, ওপি নায়ার, শঙ্কর জয়কিষণ, শচীনদেব বর্মণ, মদন মোহন, রওশান- এদের সকলের সুরেই গান করেছেন রফি সাহাব। বিশেষ করে নওশাদের সুরে গান গেয়ে রফিজি হয়ে ওঠেন সংগীতের আকাশে উজ্জ্বলতম তারকা।
১৯৫২ তে মুক্তি পায় ‘বৈজু বাওরা’। ভারত ভূষণ অভিনীত ছবিটি বাণিজ্যিক সাফল্যে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এর সংগীত পরিচালক ছিলেন নওশাদ। আর এ ছবিতেই জীবনের শ্রেষ্ঠ গানটি করেন রাফি সাহাব। ‘ও দুনিয়াকে রাখোয়ালে’ গানটিকে বলা হয় রফিজির প্রতিভার সেরা স্বাক্ষর।
১৯৬০ সালে ‘মোঘল এ আজম’ ছবিতে নওশাদের পরিচালনায় ১০০ শিল্পীর সঙ্গে কোরাসে রফিজির গান ‘আয়ে মোহাব্বাত জিন্দাবাদ’।
গুরু দত্তর অনেক ছবিতেই গান গেয়েছেন রফি সাহাব। সংগীত পরিচালক শচীনদেব বর্মণ সে সময় গুরু দত্ত এবং দেবানন্দর প্লে-ব্যাক হিসেবে রফিজিকে ব্যবহার করতেন।
রফিজি সবচেয়ে বেশি গান করেছেন লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলাল জুটির সংগীত পরিচালনায়। ৩৬৯টি গান করেন তিনি এই জুটির সুরে। এই জুটির সুরে ‘দোস্তি’ ছবিতে ‘চাহুঙ্গা ম্যায় তুঝে সাঁঝ সভেরে’ গানটি গেয়ে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার পান তিনি।
সত্তরের দশকে ‘পাগলা কাহিকা’, ‘হির রানঝা’, ‘সাওন ভাদো’, ‘জীবন মৃত্যু’, ‘দ্য ট্রেইন’, ‘সাচ্চা ঝুটা’, ‘পাকিজা’, ‘মেহবুব কি মেহেন্দি’, ‘গ্যাম্বলার’, ‘অভিমান’, ‘ইয়াদো কি বারাত’, ‘লোফার’, ‘দাস্তান’ ইত্যাদি হিট ছবিতে গান করেন তিনি।
সত্তরের দশকেই ‘তুম মুঝে ইয়ু ভুলা না পাওগে’, ‘ইয়ে দুনিয়া ইয়ে মেহেফিল’, ‘গুলাবি আঁখে’, ‘আজ মৌসাম বারা বেইমান হ্যায়’, ‘কান মে ঝুমকা’, ‘তেরে বিন্দিয়া রে’ ইত্যাদি গানে তিনি শ্রোতাদের মনে ঝড় তোলেন।
বাংলায় বেশ কিছু জনপ্রিয় গান রয়েছে মোহাম্মদ রাফির কণ্ঠে। ‘ওরে মনকে এমন দাগা দিয়ে’, ‘ওই দূর দিগন্ত পারে’, ‘নাই বা পরিলে আজ মালা চন্দন’, ‘কথা ছিল দেখা হলে’, ‘এ জীবনে যদি আর কোনোদিন’, ‘নওল কিশোর’, ‘কালো কলেবর কানহাই’, ইত্যাদি গান এখনও শ্রোতাদের মন ভরায়। তাঁর অনিন্দ্য কণ্ঠে নজরুল সংগীত ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন’ গায়কীতে আজও অনন্য।
মান্না দে, কিশোর কুমার, মুকেশ, হেমন্তকুমার, গীতা দত্ত, সুমন কল্যাণপুর, লতা মঙ্গেশকার, আশা ভোঁসলেসহ সমসাময়িক প্রায় সব শিল্পীর সঙ্গেই গান করেছেন মোহাম্মাদ রফি।
শাস্ত্রীয়, লোকজ, পপসহ সব ধরনের গানেই তাঁর পারদশির্তা ছিল অসাধারণ। কণ্ঠে মাধুর্য যেমন ছিল তেমনি ছিল চটক। কাওয়ালি, ভজন, গজল, আধুনিক কোনো গানেই তাঁর প্রতিভার কমতি ছিল না।
তিনি ছয়বার ফিল্মফেয়ার অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন। ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী সম্মানে ভূষিত করেছে।
মোহাম্মদ রফি ১৯৮০ সালের আজকের দিনে (৩১ জুলাই) মাত্র ৫৫ বছর বয়সে ম্যাসিভ হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment