—————–বধ্যভূমির পরিযায়ীরা—————-
ভাস্কর ভট্টাচার্য: কলকাতা, ১২মে ২০২০।
ছোট্টি সি পঞ্ছি,ছোট্টি সি আশা
ছোটি ছোটি সপনা (স্বপ্ন)হামারা…. তিরি তিরি নাচে রে।….
বাংলা সাগিনা মাহাতো সিনেমার সেই মিষ্টি গানটা, আমার হৃদয়ে যেন শেল বিঁধে দিচ্ছে। পাহাড় ঘেরা গাঁ, শ্রমিক মহল্লা, সুরার বোতল হাতে সাগিনা শ্রমিক মহলে গান গাইছে, শিশুদের সামনে। স্বপ্ন ওরা বড় হবে, ওদের পেটে খাবার জুটবে।
৩০ বছর ধরে যে শ্রমিক, তার জীবন নিয়ে শ্রম ঝরিয়ে মালিকদের লাভ তুলতে কাজ করেছে, এক ত্থাপ্পরে সেই শ্রমিক বেরোজগারি হয়ে পড়ে। সেই হঠাৎ কাজ হারানো শ্রমিক উদ্গত কান্না নিয়ে অন্য শ্রমিকদের প্রতি বেদনা ঝরিয়ে বলেছিল, আজ আমি লাত খেলাম, একদিন তোমাদেরও এমন দিন আসবে। সিনেমা এগিয়েছে, সাগিনা শ্রমিক দরদি নেতা হয়েছে, শ্রমিকদের একতাবদ্ধ করে নিজেদের কাজের সম্মান আদায় করেছিল। শ্রমিকরা দাবি তুলেছিল, ‘কানুন’ বানাতে হবে। শুধু কোম্পানির বিরুদ্ধে নয়, নিজের জন্যও। যে শ্রমিক বেইমান হবে, তাকে ‘মাচিস’ দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেওয়া হবে। ১৯৫৮ সালে লেখা উপন্যাস, ১৯৭০ সালে তৈরি হওয়া সিনেমা সেদিনের ব্লগ বাস্টার ছবি। দিলীপকুমার, সায়রা বানু, অনিল চ্যাটার্জি প্রভৃতি। স্মরণীয় ২০২০ সালেও। কেন যে হঠাৎ মনে পড়ল। দিলীপকুমার বাংলা গানে গলাও মিলিয়ে ছিলেন।
সময় পালটায়, ইতিহাস পালটায়। নতুন ইতিহাস তৈরি হয়। হয়েছে। শ্রমিক আন্দোলন উত্তাল হয়েছে। সমাজ সময় পঞ্চাশ বছরে আমূল বদলে গেছে। এখন ল্যাপটপ হাতে চব্বিশ ঘণ্টাই শ্রম। আট ঘণ্টার লড়াই দুর্বল হয়েছে। আর শ্রমিক? দিন দিন পাল্টাচ্ছে শ্রম ও শ্রমিকের সংজ্ঞা। নতুন খসড়ায় সূচিত হবে নতুন শ্রম আইন। এমন অবস্থায় ভারত দেখল, চটি, রুটি ও লাশ। ২০২০ সাল। বুদ্ধ পূর্ণিমার চাঁদের আলো তখনও আকাশ থেকে বিদায় নেয়নি। ১৭ জনের হা- ক্লান্ত একটা শ্রমিক পরিযায়ী দল, হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হওয়া ঘুমের মধ্যেই লাশ হয়ে গেলেন। কাব্য করে বলাই যায়, চারিদিকে ছড়ানো রুটি/হয়ে গেল জীবনের ছুটি। ‘মালগাড়ির চাকায় পিষে গেলেন ১৪ জন। ১৫০ কিলোমিটার পথ হয়ে, তারপর ট্রেন ধরে ওঁরা ওঁদের ‘পরিযায়ী’ পরিচয় মুছে ঘরে ফিরবেন, শূন্য হাতে, শুধু প্রাণটুকু হাতে নিয়ে। সেখানে পথ চেয়ে অপেক্ষায় পরিবার। না, ফেরা হল না, পথেই জীবনকে, ওদের শ্রমকে, পায়ের চটিকে, পথে ফেলেই একেবারেই পরিযায়ী হয়ে গেলেন।
সাঁতরাগাছি বিলে শীতে পরিযায়ী পাখির কথা জেনেছি। করোনা ভাইরাস পরিযায়ী শ্রমিকের কথা স্মরণ করিয়েছে। অকস্মাৎ লকডাউন, বন্ধ কারখানা, নিঃস্ব, রিক্ত শ্রমিক ‘পরিযায়ী’ হয়ে গেলেন। যে শ্রমিক জীবনের জন্য, কাজের জন্য, কোম্পানির জন্য শ্রম ঝরিয়ে, পরিবার থেকে দূরে থেকে কাজ করে নিজের প্রতি, কোম্পানির প্রতি, দেশের অর্থনীতির প্রতি দায়বদ্ধ থাকেন, হঠাৎ বিপর্যয়ে তাঁরা কেন এমন তকমা ও অসহায় হবেন সে প্রশ্ন পরে তুলব। এই পরিযায়ী শ্রমিকদের নিয়ে রাজনৈতিক তরজা, সমবেদনা, রেষারেষি, বিতণ্ডা, এক দলের বিরুদ্ধে আরেক দলের দোষারোপ,বাহানা চলছিল, চলছে, চলবেও। বিরোধীরা বলছেন হঠাৎ লক ডাউন শ্রমিকদের রাস্তায় দিনের পর দিন খোলা রাজপথে থাকতে বাধ্য করেছে।
আবার বোদ্ধা কিছু মানুষ বলছেন হঠাৎ লকডাউন না ডাকলে বিপদ আরও বাড়ত। কেউ বলছেন ওদের ফেরার ট্রেন ভাড়া আমরা দেব, কেন্দ্র ট্রেন দিন। কেন্দ্র শ্রমিক দের ভাড়ার ৮৫ শতাংশ ছাড় দিয়ে রাজ্য সরকারগুলিকে সাহায্যের হাত বাড়ানোর বা নিজ নিজ রাজ্যের শ্রমিক দের দায় বহন করার বাদানুবাদের মধ্যেই এই মর্মান্তিক করুণ দৃশ্য দেখল এই সময়, এই সমাজ। বিভিন্ন মাধ্যমে। সমবেদনার ঝড়। শ্রমিক ইউনিয়নগুলি দোষারোপ করছে সরকার ও কোম্পানি গুলির ওপর। সেখানে মালিকরা শ্রমিকদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেনি। কর্তৃপক্ষ বলছেন, শ্রমিকরা ধৈর্য হারিয়ে চলে গেছে। প্রশ্ন এখানেই, আন্তর্জাতিক শ্রমিক আইন আছে, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন আছে, বড় বড় ট্রেড ইউনিয়ন আছে, শ্রমিক সংগঠন থাকা সত্ত্বেও একটা বিপদে কেন শ্রমিকরা সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে?
সরকার কেন সেই আশ্বাস দিতে ব্যর্থ হবেন, যে আশ্বাস দিয়ে শাসন ক্ষমতায় বসে? শ্রমিকদের নিজেদের নিরাপত্তার অভাবেই এমন বিপর্যয় এ কথা বলতে দ্বিধা হয় না। তাহলে কি শ্রম আইন, শ্রমিক নিরাপত্তা দিতে ক্রমশই দুর্বল হচ্ছে ফ্যাসিস্ট শক্তির কাছে? কিছুটা হলেও হচ্ছে। শ্রম আইন পাল্টানোর কথা গত কয়েক বছর ধরেই চলছে। বাড়ছে শ্রমিকদের নিরাপত্তাহীনতা। কথায় কথায় ছাঁটাই। সব সময় শ্রমিকদের একটা আতঙ্ক তাড়া করে বেড়ায়। করোনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল না কি? এই বিপর্যয়ের ফলে কোটি কোটি কর্মহীন হবেন। শ্রমজীবী কর্মহীন হবেন।
সেখানে মাত্র চোদ্দ জন লাশ হলেন।! এটা প্রতীক। এ পর্যন্ত পথেই পরিযায়ী ৪০ জন মারা গিয়েছেন। পথে বিপথে সংখ্যা চতুর্গুণ হবে। এই সময়ে বড় বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠেন দার্শনিক চিন্তাবিদ ফ্রিডরিখ এঙ্গেলস। ১৮৭৬ সালে পাতলা চটি একটা বই লিখেছিলেন জার্মান ভাষায় পরে তা ইংরেজিতে অনুবাদ হয়েছিল। নাম দ্য পার্ট প্লেইড বাই লেবর ইন দ্য ট্রাঞ্জিশন ফ্রম এভিল টু ম্যান’। যাতে তিনি লিখেছিলেন, মানুষ ও জীবজগতের সবচেয়ে বেশি নিয়ামক শক্তি হচ্ছে শ্রম। মানুষের সৃজনশীলতা, প্রতিবাদ- প্রতিরোধের মধ্যেই রয়েছে শ্রমশক্তি’। একজন শ্রমিক সেই শক্তিই দেন। আর তারই বিনিময়ে সে চায় সম্মান, পারিশ্রমিক ও সামাজিক নিরাপত্তা। আর সেই নিরপত্তারই অন্তঃসার শূন্যতার মুখে শ্রমিক পরিযায়ী। সারা পৃথিবীতে কমিউনিস্ট বা বামপন্থীরাই শ্রমিক স্বার্থে লড়াই করেছে, মার্কস, লেনিনের দেখানো পথে।
যা আজ দক্ষিণপন্থীর ফ্যাসিজিমের কাছে পরাভূত। কণ্ঠস্বর জোরালো করার মতো কণ্ঠ আজ বিপথগামী। যেমন মৃত্যূর পথে হাঁটা ওই শ্রমিকরা। ওই পথ হাঁটা শ্রমিকরা যেন আরও এক কালো মেঘের বার্তা দিয়ে গেল। সাগিনা হারিয়ে গেছে! মনে পড়ছে ওই ছবিরই শেষ ডায়ালগ, সাগিনা, জান দিয়ে লড়তে হবে, থামলে চলবে না, তৈরি হও সাগিনা, সত্যিকারের লড়ার জন্য তৈরি হও। কানুন চাই। কাজ না-হারানোর আশ্বাস চাই। কে দেবে? ওই চল্লিশ জন গেছেন চল্লিশ কোটি যাবার প্রতীক্ষায় দু চোখে ঘুমহীন নিরাপত্তাহীনতায়। জন্মভূমি বধ্যভূমি হয়ে ওঠার অপেক্ষায়।
একদল সাগিনা দরকার।
Be First to Comment