Press "Enter" to skip to content

স্মরণ:- কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য

Spread the love

বাবলু ভট্টাচার্য, ঢাকা, বাংলাদেশঃ জন্মেছিলেন এমন এক সময়ে, যখন পপ আর রকের দাপটে বাঙালির আটপৌরে আঞ্চলিক গানগুলো ডুবে যাচ্ছিল অবহেলার আঁধারে। তার একক প্রচেষ্টাতেই সেই অনাদর থেকে মূলধারায় স্রোতে ফেরে লোকগান।

গানের দল ‘দোহার’-এর কাণ্ডারি, কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য’র সুরের সুতোয় দুই বাংলাকে একত্রে গাঁথার প্রয়াস যখন সবে শুরু, ঠিক তখনই বর্ধমানের এক সড়ক দুর্ঘটনা থামিয়ে দিল সব।

আসামের শিলচরের ভট্টাচার্য পরিবারের সবাই ছিলেন কোনো না কোনোভাবে গানের সঙ্গে যুক্ত। তাই এই পরিবারের ছেলে গানকেই করবেন জীবনের ধ্যান-জ্ঞান, এ ঘটনা বিস্ময় জাগায়নি কারো মনে। তবে বাবা রামচন্দ্র ভট্টাচার্য’র দেখানো ধ্রুপদী সংগীতচর্চার পথে না এগিয়ে কালিকা ঝুঁকেছিলেন কাকার লোকগানের আধ্যাত্মিক দর্শনেই।

কাকা অনন্ত ভট্টাচার্য’র সংগ্রহে ছিল পাঁচ হাজারেরও বেশি লোকগান। সেসব শুনতে শুনতেই বড় হয়েছেন কালিকা। আর সেইসব গানকে অবলম্বন করেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দিনগুলিতে বন্ধুদের নিয়ে গড়ে তোলেন গানের দল দোহার।

নতুন সহস্রাব্দের সূচনা লগ্নে সবাই যখন ঝুঁকছে পশ্চিমা সুর-লয়ের দিকে, ছাত্রদের ব্যান্ড মানেই যেখানে সফট, অল্টারনেটিভ থেকে শুরু করে হার্ড ও প্রগ্রেসিভ রক ঘরানার গান, সেখানে ‘দোহার’ যেন ছিল এক ব্যতিক্রমী নাম। নিজেদের মৌলিক গান দিয়ে নয়, দোহার পরিচিত পেয়েছিল আবহমান বাংলার বাউল, কীর্তন, ঝুমুর, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, চটকার মতো ভুলতে বসা লোকগান নতুন করে তুলে এনে।

‘দোহার’-এর দর্শন আর নিজের সংগীতচর্চার চিন্তাধারাকে তুলে ধরে কালিকাপ্রসাদ বলেছিলেন, “আমরা লোকগান গাই। নতুন গান লিখি না বা গাই না। আমাদের গানে পশ্চিমী বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার হয় না। সেই জন্যই ‘দোহার’ গানের দল। ব্যান্ড নয়।’’

শুধু লোকগান গেয়েই তাদের একটা নিজস্ব শ্রোতা তৈরি হয়। চিরচেনা সুরগুলোকেই নিজস্ব আঙ্গিকে বাজানোর কায়দা, বিভিন্ন মেঠো বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, খোল, মাদল, ধামসা, সারিন্দা, ডুবকি, খঞ্জনি বাজিয়ে গানের সঙ্গে ধ্বনির বাতাবরণ তৈরির ব্যাপারগুলোকেই দারুণভাবে গ্রহণ করে।

প্রান্তিক জনগোষ্ঠী হওয়ার পরও গোঁড়া ধর্মীয় আর সামাজিক বেড়াজালকে ছিন্ন করা বাউলেরা যেভাবে গানে গানেই প্রচার করেছেন নিজেদের দর্শন, ঠিক একইভাবে একালের গণজাগরণের আন্দোলনেও নিজের হাতিয়ার হিসেবে গানকেই তুলে নিয়েছিলেন তিনি।

২০১৩ সালে সেভাবেই তৈরি হয়েছিল ‘শাহবাগ দিচ্ছে ডাক’ গানটি। এ প্রসঙ্গে কালিকা বলেছিলেন, সাধারণত গান না লিখলেও ‘প্রাণের তাগিদে’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শুরু হওয়া শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হতে তিনি লিখেছিলেন গানটি।

সিনেমাতে কালিকাপ্রসাদ-এর গাওয়া গান এর আগে ব্যবহার হয়েছে দুবার, সৃজিত মুখোপাধ্যায়-এর ‘জাতিস্মর’ আর গৌতম ঘোষ-এর ‘মনের মানুষ’-এ। তবে বাংলাদেশের প্রতি নিজের ‘প্রাণের তাগিদে’ই প্রথমবারের মতো সংগীত পরিচালনা করেন তিনি সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভুবন মাঝি’তে।

মুক্তিযুদ্ধ এবং সমকালীন সময়ের মৌলবাদ ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঘিরে তৈরি হওয়া সিনেমাটির প্রাণই ছিল কালিকাপ্রসাদ-এর সংগীত।

সিনেমায় ব্যবহার হয়েছে মাত্র চারটি গান, যা মূলধারার বাংলা সিনেমার তুলনায় কমই বলা যেতে পারে। তবে এই ক’টি গান দিযেও সিনমাজুড়ে যে মায়াজাল তৈরি করেছেন কালিকাপ্রসাদ, তা এককথায় অনবদ্য।

‘আমি তোমারই নাম গাই’ গানটি ইউটিউবের সুবাদে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এরমধ্যেই; সহজ-সরল কথা আর একেবারেই আটপৌরে সুরের গানটি দিয়ে যেন চিরচেনা বাঙালির মধ্যবিত্ত প্রেমকে তুলে ধরেছেন কালিকাপ্রসাদ।

ওদিকে ‘ছিল ছায়া ঘেরা পাখি ডাকা’ গানটিতে বারবার যুদ্ধের আঘাতে বাঙালির শেকড়ছিন্ন হয়ে নিরুদ্দেশ যাত্রার কষ্টই উঠে আসে গ্রামীন সুরের আবহে। গানটি ঘরের কাজ করতে করতে গুনগুন করে গেয়ে ওঠার গান, দীর্ঘ শোষণ আর বঞ্চনার কান্না লুকিযে প্রতিরোধের ডাক দেওয়ার গান।

আবার ‘বোতলে পুরেছি কান্না’ পুরোপুরি ভিন্ন মেজাজের গান; নাগরিক কপটতার কালে বিবেককে উজাড় করে ‍নির্মোহ সত্যকে তুলে ধরার গান যেন এটি। অ্যাকুস্টিক গিটারের সুর আর শহুরে কথার গানটি অনায়সেই জ্বালাতে পারে বিদ্রোহের আগুন।

তবে কালিকাপ্রসাদ-এর নিজের মেজাজের সঙ্গে যে গানটি সবচেয়ে সঠিকভাবে যায়, সেটি হলো ‘পদ্মা নদীর নৌকা ভিড়েছে হুগলি নদীর তীরে’। সিনেমার অভিনেতা পরমব্রত-র কণ্ঠ দেওয়া গানটি কথায় কিংবা সুরে, সব দিক থেকেই যেন তুলে ধরে দোহার-এর দর্শনকে। লালনের গানের কথার সঙ্গে তো মিলে যাবেই এই গানের কথাগুলো, সেই সঙ্গে ভালোবাসার বাঁধনে দুই বাংলার মানুষকে একই সমতলে নিয়ে আসার স্বপ্নের কথা বলে গানটি, যে স্বপ্ন অনেকের মতোই কালিকাপ্রসাদ নিজেও প্রবলভাবে দেখেছেন।

তো সেই হুগলিরই হোক, আর পদ্মাপারেরই হোক- গণমানুষের গান একজীবনে যেভাবে তুলে এনেছেন কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য, তাতে করে চিরস্মরণীয় হযেই তিনি রযে যাবেন দুই বাংলাতেই।

কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য ২০১৭ সালের আজকের দিনে (৭ মার্চ) হুগলী জেলার গুরাপ গ্রামের কাছে এক সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.