প্রবীর রায় : প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা। কলকাতা, ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৪। এটা সেই সময়ের ঘটনা যখন বাঙালি এক পাত্তর হুইস্কি সেবন করে অথবা অনাদির মোগলাই খেয়ে সিনেমা দেখতে হলে ঢুকত ব্ল্যাকে টিকিট কেটে। আর যারা কয়েকদিন আগেই আ্যডভান্স টিকিট কেটে চলে যেত সটান হলে। সিনেমা ভাঙার পর রেস্তোরায় খাওয়া দাওয়া, নিউ মার্কেটে শপিং করা, ফেরার সময় হাতে থাকতো গরম প্যাটিস, কেক। টুক করে ট্রাম ধরে সিনেমার সেই গল্প করতে করতে বাড়ি।
এলিটিসিজম ও রোম্যান্টিসিজমের সেই আঁতুড়ঘরটি ছিল ‘গ্লোব’ … দুটি শব্দের চাবুক চালানো শিহরণ ছিল যার শরীরে … লিন্ডসে স্ট্রিটে ঢুকে ডান হাতের ছোট একচিলতে গলি দিয়ে ঢুকে বাঁ হাতে ছিল কাউন্টার … ডান হাতে বার … দোতলায় কাচের দরজা ঠেললে আরও একটি বার … সেখানেই দরজা ঠেলে ভিতরে পুরু গালিচা পথ নিয়ে যেত গদি মোড়া সিটে … ডিমার কোন অলক্ষে অফ হত টেরই পেতাম না … অন্ধকারের রূপকথায় তখন গ্রেগরি পেক … আন্থনি কুইন … ওমর শরিফ …. উরি উরি বাবা কী দারুণ মেরি উর …. মা কসম, সেদিনের সেই গ্লোব আজকের মাল্টিপ্লেক্সগুলোকে বলে বলে গোল দিতে পারত … সেই রোমহর্ষক গ্লোবের সামনে মাল্টিপ্লেক্সগুলো যেন হঠাৎ দু’ পয়সা করে ফুটানি মারা ছিঁচকের দল, এখন সেখানে আরতি নামে একটি সংস্থা শপিং মল বানিয়েছে, যেখানে ব্র্যান্ডেড ন্যাকড়া বিক্রি হয়…!
আর গ্লোব নামটিকে ছুঁয়ে রেখে একটি পুচকি হল বানাচ্ছে যেটা বড়জোর ভিডিয়ো পার্লারেরই বড়ভাই গোছের…।
ন্যাকড়া বিক্রি হয় টাইগারেও … এখানে দেখেছিলাম ডায়মন্ড স্মাগলার … টোয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস্ আন্ডার দ্য সী।
কলকাতায় কোনও নীল সমুদ্র নেই … তবুও তার একটি লাইটহাউস ছিল … তার দোতলায় পরম যত্নে রাখা ছিল একটি পিয়ানো … কোনও দিন একটি আঁচড়ও তাতে লাগেনি … এক মন সম্ভ্রম নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে থাকত হলিউডি সিনেমাখোর বাঙালি … হয়ত তাতে কখনও তুলতুলে আঙুলে রিনরিনে সুর তুলত কোনও রাজকন্যে … সেখানেই দেখেছিলাম, রাইডার ইন দ্য রেইন … চার্লস ব্রসনন … টাওয়ারিং ইনফার্নো … স্টিভ ম্যাকুইন … রিটার্ন অফ দ্য ড্রাগন … ব্রুস লী।
এখন সেখানে ড্রেস মেটিরিয়ালের কেচ্ছা … লাইট হাউস আর বাতি জ্বেলে পথ দেখায় না … কলকাতাটাই যে ডুবতে বসেছে…।
গা ঘষাঘষি করে নিউ এম্পায়ার … কোনও এক মহাজাগতিক বিস্ময়ে সেটি এখনও টিকে রয়েছে… ইম্পেরিয়াল হাউস … শ্বেত পাথরের বাঁকানো সিঁড়ি উঠে গিয়েছে … বেলজিয়াম গ্লাসের মিরর … দেওয়ালে হিচককের দ্য বার্ড, রোমান হলিডের অদ্রে হেপবার্নের, come september এর জানা লোলোব্রিগেডার বাঁধানো পোস্টার … ভিতরে হোয়ার ইগলস ডেয়ার … রিচার্ড বার্টন, ক্লিন্ট ইস্টউড…
আর ছিল এলিট একমাত্র যেখানে ‘Ginger Beer’ (non alcoholic) পাওয়া যেত। আমরা যখন school এর উঁচু class এ, তখন ঐ Beer খেয়ে একটা নিষিদ্ধ আনন্দ উপভোগ করতাম! একজন জুতো ব্যাবসায়ী ওখানে বোধহয় জুতোর শোরুম করবেন। এখানেই দেখেছি এলভিস প্রেসলির “Love me Tender ” “Sunmer of 42 ” Robert Redford এর “The Great Gatsby ” র মতো বিখ্যাত সব ফিল্ম।
জ্যোতির কথা জানেন?
মাইরি বলছি, সেটি এখন ছাঁট লোহার গোডাউন … আদিগন্ত বিশাল পর্দায় ঘোড়া ছুটত গব্বর সিং আর তার সাঙ্গপাঙ্গোদের … ঠাকুর সাহাবের সঙ্গী দুই ছিঁচকে চোর জয় আর বীরুর সেই টক্কর-দৃশ্য … স্টিরিও সাউন্ড;… জ্যোতি জ্যোতিই… তার কোনও বিকল্প ছিল না… এখনও আছে কি?
প্রাক ইন্টারনেট আর ইন্টারনেট উত্তর সময়ের মধ্যে কলকাতার চৌরঙ্গির সিনেমা পাড়া নিশব্দে চুরি হয়ে গেল।
রোম্যান্টিসিজমের কফিনে পেরেক পুঁতে দেওয়া হল ….
তো এই কলকাতাকে লইয়া কী করিব …. কী বা পাবার আছে আর এই আধমরা কলকাতা থেকে?
আমরা আধ-বুড়ো-হাবড়ার দল ভাবি আর মনে মনে অশ্রুমোচন করি…।
*আচ্ছা কলকাতার একটা শ্রাদ্ধ করলে হয় না?*
Be First to Comment