সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ মুম্বাই এর বান্দ্রার এক হাসপাতালে আজ ভোর ৩ টে ৪৫মিনিটে শেষ নিশ্বাস ফেলল অভিনেতা তাপস পাল।বয়স হয়েছিল মাত্র ৬১ বছর।ডাক্তাররা বলেছেন, হৃদরোগে তাপস আক্রান্ত হয়েছিলেন।বেশ কিছুদিন ধরে স্নায়ু রোগে ভুগছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক, সাংসদ ও অভিনেতা তাপস পাল। তাপসের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়।
আজই তাঁর মৃতদেহ কলকাতায় নিয়ে আসা হয়েছে। তাপস রেখে গেল তাঁর স্ত্রী নন্দিনী, কন্যা সোহিনী এবং অসংখ্য সহকর্মী শিল্পী ও অনুরাগীদের। সকালে ঘুম থেকে উঠতে না উঠতেই যে কোন মৃত্যু সংবাদ পেলে সবারই মন ভেঙে পড়ে।আর চলে যাওয়া মানুষটির সঙ্গে যদি একটা নিকট সম্পর্ক থাকে তাহলে তাঁর বিয়োগ ব্যথা হৃদয়কে কতটা আঘাত করে তা ভাষায় প্রকাশ সম্ভব নয়।সময় টা ছিল ১৯৮১। এই প্রতিবেদকের সাংবাদিকতার বয়স সবে দেড় বছর।অন্যদিকে চন্দননগরের ছেলে তাপস পাল পরিচালক তরুণ মজুমদারের দাদার কীর্তি ছবির দৌলতে জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
সেই সময় সে রোজ লোকাল ট্রেনে চন্দননগর থেকে টালিগঞ্জ স্টুডিও পাড়ায় যাতায়াত করত।স্টুডিওতে পরিচয়টা হয়েছিলো।একদিন ঠিক করলাম তাপসের চন্দনগরের বাড়িতে হঠাৎ পৌঁছে সারপ্রাইজ দেবো।এক রবিবারের সকালে ক্যামেরাম্যানকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছে গেলাম তাপসের বাড়িতে। ওতো ভূত দেখার মত চমকে উঠলো। ও আশা করতে পারেনি কলকাতা থেকে কোনো সাংবাদিক তার বাড়িতে আসবে ।আমি তখন বাংলার জনপ্রিয় মাসিক চলচ্চিত্র ও সাহিত্যের পত্রিকা উল্টোরথের সাংস্কৃতিক সম্পাদক।তাপস ঘরে নিয়ে গিয়ে বাবা মা ও দিদিদের সঙ্গে পরিচয় করালো।আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান নানান ভঙ্গিমায় তাপসের ছবি তুললো।আমি নিলাম একটা দীর্ঘ ইন্টারভিউ।তাপস জানালো তার বাড়িতে এসে ইন্টারভিউ আমিই প্রথম নিলাম।কথাটা তাপস কিন্তু পরে যখন ও সুপারস্টার হলো তখনও মনে রেখেছিল।সেদিন তাপস ইন্টারভিউতে বলেছিল বাবা মা চাইতেন ছেলে যেন ডাক্তার হয়।কিন্তু তাপস হল অভিনেতা। এরপর তাপসের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাড়লো। প্রায়ই আমি, তাপস এবং ওর এক অবাঙালি প্রযোজক বন্ধু বসতাম পার্ক স্ট্রিটের একটি রেস্তোরায়। সবে মদ্যপান করতে শিখেছে । আমাকে আড়াল করে বসতে হতো। তাপস দ্রুত গ্লাস খালি করত।আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ,তুমি স্টার।কাকে ভয় পাচ্ছো?তাপস জবাব দিয়েছিল ভয় তনুদাকে। জানলে মেরে ফেলবে। তনুদা অর্থাৎ তরুণ মজুমদার।সে সময়ে লোকাল গার্জেন ছিলেন তরুণবাবু। নিজের বাবা ছাড়া আর যদি কাউকে ও বাবার মত শ্রদ্ধা করত তিনি তরুণবাবু।সেই সময় কাজের সুবিধের জন্য তাপস একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করেছিল কৃত্তিবাস লেনে। রাসবিহারী মোড়ে টালিগঞ্জ ফাঁড়ির কাছে।সেখানেই চলতো আমাদের আড্ডা। একদিন আমার অফিসে এসে হাজির।জানালো বিয়ে করছে সে।প্যারিস ক্লাবে রিসেপশন। আলাপ হলো ওর স্ত্রী নন্দিনীর সঙ্গে । বাগবাজার মাল্টিপারপাসের ছাত্রী। উত্তর কলকাতার মেয়ে। বিয়েতে হাজির ছিল পুরো টলিউড। তাপসের সময়ের সেরা নায়িকা ছিলেন মহুয়া রায়চৌধুরী। ওরা ভালো বন্ধুও ছিল । ওর বন্ধুর তালিকায় আর একজন মুনমুন সেন। মনে পড়ছে অরুন্ধতী দেবীর দীপার প্রেম ছবির কথা ।মনে পড়ছে রথীন মজুমদারের অজান্তে ছবির কথা ।অনুরাগের ছোঁয়া ছবির শুটিং এর কথা ।একবার বাড়িতে নিজের পোষ্যকে আদর করতে করতে তাপস পরামর্শ চাইল কংগ্রেস থেকে রাজনীতিতে আসার আমন্ত্রণ এসেছে ।কি করা উচিৎ? আমি জানতাম তাপস দক্ষিণপন্থী ঘরানায় মানুষ ।তবু বললাম,তোমার অনুরাগীদের মধ্যে বাম ডান সবাই আছেন।তাই সরাসরি রাজনীতিতে না যাওয়াই ভালো।তোমার মানসিকতার সঙ্গে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের খাপ খায় না। তাপস আমার কথা মেনে না অন্য কারণে রাজনীতিতে গেলো না, সেটা জানিনা। এরপর অনেক দিন বিচ্ছিন্ন ছিলাম । দূরদর্শনের এক টেলিফিল্ম করতে গিয়ে এক ডাক্তারের চরিত্রে তাপসকে অভিনয় করতে বললাম ।এক কথায় রাজি।বেলা বারোটায় ফ্লোরে আসার কথা।
এলো এক ঘন্টা দেরিতে । ঝগড়া করলাম প্রবল।তাপস বললো সরি গুরু, ঘুম থেকে উঠতে দেরি হয়ে গেছে।
লাঞ্চে সহঅভিনেতা শঙ্কর চক্রবর্তী অর্ডার দিল শসা আর টকদই। তাপস অর্ডার দিল দু প্লেট বিরিয়ানি। আমি বললাম, তোমার ভূঁড়ি বাড়ছে।দুপ্লেট বিরিয়ানি খাওয়া উচিত নয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা।আসলে খেতে খুব ভালবাসত।
হঠাৎ একদিন শুনলাম ও রাজনীতিতে আসছে। প্রথমে বিধায়ক, তারপর সাংসদ হলো।ফলে ব্যস্ত হলো নতুন জীবনে।আমাদের দূরত্বও বেড়ে গেলো ।তবে হঠাৎ দেখা হলে আমরা পরস্পর জড়িয়ে ধরতাম দুজনকে। এই মুহূর্তে স্মৃতির মিছিল চোখের সামনে । মায়ের সঙ্গে মামলা, সারদা নিয়ে বিতর্ক,সবশেষে সভার বক্তব্যে অসংলগ্ন শব্দ প্রয়োগের বিতর্কে তাপস জড়িয়েছেন।আজ সব বিতর্কের উর্ধে তাপস পাল। নক্ষত্রের পতন বলবো না উল্কার পতন বলবো ভেবে পাচ্ছি না।
সাহেব, দাদার কীর্তি, মানুষের অনুরাগের ছোঁয়ায় আশির্বাদ হয়ে ঝরে পড়েছে তাঁর জীবনের সুরের আকাশে। মানুষের ভালোবাসা ভালোবাসা পেয়ে তিনি গুরু দক্ষিণা দিয়ে গেছেন অনুরাগীদের ।সবাই তাঁকে ভাবত আপন আমার আপন। সুরের আকাশে মিলিয়ে গিয়ে জীবনের সমাপ্তি ঘটলো আজ।
Be First to Comment