Press "Enter" to skip to content

সখি ভালোবাসা কারে কয়?

Spread the love

সুজিত চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা, ১৪ই জানুয়ারি ২০২০ আজ ১৪ ফেব্রুয়ারি। ” ভ্যালেন্টাইন ডে”।বিশ্বের মানুষ দিনটি পালন করেন ভালোবাসার দিন হিসেবে। লাল গোলাপ আর চকোলেট এই উৎসবের প্রধান উপকরণ। ভ্যালেন্টাইন ছিলেন ধর্মযাজক। সময়টা ২৭০ খ্রিস্টাব্দ। প্রেমের বিয়েতে তীব্র আপত্তি ছিল রোমান সম্রাট দ্বিতীয় ক্লডিয়াস। তিনি দেশে বিবাহ নিষিদ্ধ করে দেন ।

বিদ্রোহ করেন রোমের গির্জার বিশপ সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি রাজার আদেশ অগ্রাহ্য করে ছেলে মেয়েদের বিয়ে দিতে থাকেন। স্বাভাবিক ভাবেই রাজ রোষের শিকার হন। বন্দী করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি। এরপর কেটেছে একশো বছর। ৩৫০ খ্রিস্টাব্দে রোমের যে স্থানে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় সেখানে সেন্ট ভ্যালেন্টাইনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গড়ে তোলা হয় এক গির্জা। এরও পরে প্রায় দেড়শো বছর কেটে যায়। রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেয় খ্রিস্টান ধর্মকে। ৪৯৬ খ্রিস্টাব্দে বিশপ গ্লোসিয়াস কলঙ্কিত ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে উৎসর্গ করেন ভ্যালেন্টাইন ডে হিসেবে। সেই শুরু। আজ আমাদের দেশেও জনপ্রিয় হয়েছে এই বিশেষ দিনটি। ইতিহাসের নিরিখে অবশ্য বিষয়টি দশ চক্রে ভগবান ভূত হয়েছে। আসলে ভ্যালেন্টাইন বন্দী হন খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারের জন্য।

কেননা রোমে তখন পৌত্তলিক ধর্ম ছিল। গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পুরোহিত প্রেমে পড়েন এক নারী কারাগার কর্মীর। কিন্তু সে যুগে ধর্মীয় পুরোহিতদের বিয়ে ছিল নিষিদ্ধ। মোদ্দা কথা প্রেমের জন্য মৃত্যুদণ্ড নয়। তার শাস্তি হয়েছিল খ্রিস্টান ধর্মের প্রচারের জন্য। যদিও কোনটি যে আসল ঘটনা তাও আজ নির্দিষ্ট হয় নি।
কিন্তু কর্পোরেট ব্যবসায়ীদের দৌলতে দিনটিতে উপহার বিনিময়ের প্রথা চালু করে দেওয়া হয়। আজ তাই প্রেমিক যুগল শুধু নয়,স্বামী স্ত্রী , বন্ধু বান্ধবী উপহার বিনিময়ের মাধ্যমে ভালোবাসার না বলা কথাটি প্রকাশ করেন। এতে প্রেম কতটা দৃঢ় হয় ত বলা না গেলেও ব্যবসায়ীরা লাভবান হয়েছেন সন্দেহ নেই।
রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, সখি ভালোবাসা কারে কয়? মজার কথা, ভালোবাসা নিয়ে বিখ্যাতদের উক্তি কিন্তু প্রেমিক প্রেমিকাদের চিন্তায় ফেলে দেবে।রবীন্দ্রনাথ বলেছেন নারীর প্রেমে মিলনের সুর বাজে, পুরুষের প্রেমে বিচ্ছেদের বেদনা। কবি বায়রন বলেছেন, প্রেম মানুষকে শান্তি দেয় স্বস্তি দেয় না। বার্ণর্ড শ বলেছেন, প্রেম হলো সিগারেটের মতো। যার আরম্ভ হলো অগ্নি দিয়ে, আর শেষ পরিণতি ছাই দিয়ে। টেনিসন বলেছেন ,ভালোবাসা যা দেয় কেড়ে নেয় তার চেয়ে বেশি।

লা চেফউকোল্ড বলেছেন,প্রেম হলো প্রেতাত্মার মতো,এই নিয়ে সবাই বলে,কিন্তু কয়েকজনই
এর দেখা পায়। রুক জ্যাকসন বলেছেন প্রেম হচ্ছে স্বার্থসিদ্ধির চরম অভিব্যক্তি।
আবার বহু বিখ্যাত মানুষ প্রেমের ইতিবাচক দিকের কথা বলেছেন । এবার বরং বিজ্ঞান কি বলে দেখা যাক। মার্কিন দেশের নর্থ ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীদের দাবি , গান গেয়ে প্রেম নিবেদন শুধু মানুষ করে না, বাহন মূষিক কুলেও পছন্দ মত সঙ্গিনীকে গান গেয়ে প্রেম নিবেদন করেন। গান পছন্দ হলে নারী মূষিক যৌনতার প্রস্তাবে সাড়া দেয়। টিকটিকি, বানর, বেবুন, শিপাঞ্জী, গরিলা,কুকুর প্রভৃতি প্রাণীর প্রেম নিবেদনের আলাদা আলাদা ভাষা আছে।
বিজ্ঞানীদের স্পষ্ট বক্তব্য, নরনারীর পারস্পরিক আকর্ষণ কোন দৈব আশির্বাদ নয়। যৌন আকর্ষণে প্রেম আবশ্যিক নয়। সেটা যদি হতো সভ্যতার শুরুতেই গণিকালয় গড়ে উঠত না। পুরুষের প্রেম ভাগ্য আসলে লেখা আছে হাতের আঙুলের তর্জনী ও অনামিকার অনুপাতে। এর সঙ্গে আছে হরমোন টেস্টোস্টেরনের সূক্ষ্ম সম্পর্ক। ম্যাকগ্রিল ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা বলছেন, নারীরা ওই পুরুষের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হন, যার অনামিকা তুলনামূলক ভাবে বড় হয়। কিম্বা তর্জনী ছোট হয়।প্রেম আসলে এক জিনগত স্বার্থপরতার প্রতীক ।অক্সিটোসিন হরমোনের ক্ষরণে আমরা নিজের অস্তিত্বের জন্য নিরাপদ সঙ্গীকে খুঁজি এই হরমোনের প্রতিক্রিয়ায়। ব্যক্তি বিশেষের বাহ্যিক ও মানসিক অবস্থার বিকাশের বিষয়গুলি যখন বিপরীত লিঙ্গের মনস্তত্ত্বে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সমর্থন যোগায়,তখন তা প্রেম নামে অভিহিত হয়।
১৯৯১ সালে ৪১জন মৃত মানুষের মস্তিষ্কের হাইপোথ্যালামাস নামের অংশটা নিয়ে পরীক্ষা করেন আমেরিকার সন্দিয়েগোর সক ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিকাল স্টাডিজের বিজ্ঞানী সাইমন লিভে ।দুটি মানুষের পারস্পরিক আকর্ষণ গড়ে ওঠে মস্তিষ্কের গঠনের তারতম্যে। এই ফারাক মেলে মস্তিষ্কের সেই অংশে, যার নাম ইন্টার স্টিশিয়াল নিউক্লিয়ার অফ দা আন্তেরিয়র হাইপো থ্যালামাস থ্রি (আই এন এ এইচ থ্রি) যা আইনা থ্রি নামে পরিচিত। দেখা গেছে মহিলার তুলনায় পুরুষের আইনা থ্রি’ র আয়তন দ্বিগুণের বেশি।
প্রেম যে ঐশ্বরিক বিষয় নয়,তার ইঙ্গিত কিন্তু আজ থেকে ২৪০০বছর আগে দিয়ে গেছেন গ্রীক দার্শনিক প্লেটো। তাঁর সিম্পোজিয়াম এ লিখেছেন , কিভাবে পুরুষ ও মহিলার মনে এলো পারস্পরিক এর প্রতি আকর্ষণ। প্লেটোর ব্যাখ্যা,মানুষ নাকি প্রাচীন যুগে প্রথমে সৃষ্টি হয় তিন জোড়া।দুটি পুরুষ একসঙ্গে একটা শরীর, দুই নারী এক শরীর এবং এক পুরুষ এক নারী এক শরীর। গ্রীক দেবতা জিউস এদের আলাদা করেন । ফলে শক্তিহীন হয়ে মানুষ ঈশ্বরকে ভয় পেতে শুরু করে।সেই থেকে মানুষ একাকিত্বে ভুগতে থাকে।শুরু হয় মুক্তির আকুতি।দেবতার দয়াতে নারী পুরুষ একে ওপরের প্রতি আকর্ষিত হতে থাকে। বেঁচে থাকার প্রেরণা পায়। আধুনিক যুগে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, মে য়েরা মূলত পুরুষের বুদ্ধি,আবেগ ,সম্পদ আর কতটা দায়িত্ব প্রবণ খোঁজে।আর পুরুষ খোঁজে আদিম যৌনতার রেশ।
সাম্প্রতিক সংবাদ সূত্র বলছে জাপানে ৬০শতাংশ অবিবাহিত নারী বিয়ে করতে চাইছেন না।ছেলেরাও তাই বিকল্প যৌনতার জন্য নারী রোবট কিনছেন ।

এখন ইন্টারনেটের যুগে ছেলেমেয়েরা গুগল সার্চ করে ডেটিং করছেন ভারচুয়ালি।সেখানে ৪২ শতাংশ ছেলে মেয়ে তাদের তথ্য গোপন করে নিজেকে প্রতিযোগিতার বাজারে লাইক বাড়াতে চাইছেন। এ এক অদ্ভুত বিকল্প। অর্থাৎ প্রেম এখানে মুখ্য নয় ।
তবু প্রেম যেন সুস্থ জীবনে চলার পথে সঙ্গী।প্রেম যোগায় বেঁচে থাকার প্রেরণা। হোক তার নাম স্বার্থপরতা।

প্রেম পরোক্ষে যোগায় সৃষ্টির দায় বোধ।বাঙালির বড় ভরসা রবীন্দ্রনাথ। তিনিতো বলে গেছেন আমি তোমার প্রেমে হবো সবার কলঙ্কভাগী।তিনি বলেছেন ,প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে কে কোথায় ধরা পড়ে কে জানে?প্রেমিকাকে কবি বলেন, ভালোবেসে সখী , নিভৃতে যতনে, আমার নামটি লিখো তোমার মনের মন্দিরে। অথচ তাঁর সৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে যদি তাঁর স্বীকারোক্তি দেখি দেখবো তিনি বলছেন , যাকে তোমরা ভালোবাসা বলো,সেরকম করে আমি কাউকে কোনদিন ভালোবাসিনি।বন্ধুবান্ধব, সংসার, স্ত্রী পুত্র, কন্যা কোনো কিছুই কোনদিন আমি তম করে আঁকড়ে ধরিনি। ভিতরে এক জায়গায় আমি নির্মম, তাই আজ যে জায়গায় এসেছি সেখানে আসা আমার সম্ভব হয়েছে , তা যদি না হতো,যদি জড়িয়ে পরতুম, তাহলে আমার সব নষ্ট হয়ে যেত।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.