বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বাংলাদেশ মাত্র চল্লিশ বছর বয়সে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন শত বছরের নিঃসঙ্গতাকে। তিনিই ম্যাজিকাল রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতা, সাহিত্যের মোহনীয় ধারার সাথে সারা পৃথিবীর মানুষকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। স্প্যানিশ ভাষায় তাঁর সাহিত্য, বিশ্বসাহিত্যের সম্পদে পরিণত হয়েছিল তার জীবদ্দশাতেই, পেয়েছেন তার স্বীকৃতিও। চতুর্থ লাতিন আমেরিকান হিসেবে লাভ করেন নোবেল পুরস্কার।
তিনি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ। ডাকনাম গ্যাবো।
ফার্মাসিস্ট বাবার কাজের কারণে শৈশবে দাদু-দিদিমার কাছে মানুষ। গ্যাবোর দিদিমা ছিলেন একজন অসাধারণ গল্প বলিয়ে। অদ্ভূতুড়ে জিনিসকে এমনভাবে বর্ণনা করতেন যেন মনে হত তিনি তা চাক্ষুষ দেখেছেন। নানারকম ভূত-প্রেত, আত্মা, অলৌকিক বিষয়াদির বইয়ে ভর্তি ছিল তাদের বাড়ি।
গ্যাবো তাঁর সাহিত্যে ম্যাজিক রিয়েলিজম বা জাদু বাস্তবতার যে প্রকাশ করেছেন, তার প্রথম পাঠ নেন এভাবেই, দিদিমার কাছে। দিদিমার এই গল্প বলার ধরণ তার সবচেয়ে বিখ্যাত বই One Hundred Years of Solitude-কে ব্যাপকভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল বলে মনে করেন গ্যাবো।
গ্যাবোর দাদুও কিন্তু কম যান না! ‘হাজার দিনের যুদ্ধ’ নামে খ্যাত কলম্বিয়ার গৃহযুদ্ধে তিনি লিবারেল পার্টির কর্নেলের দায়িত্ব পালন করেন। স্বভাবতই তাঁর শেখানোর পদ্ধতি ছিল ভিন্ন। তিনি শেখাতেন বিভিন্ন অভিধান থেকে, সার্কাসে নিয়ে যেতেন প্রতি বছর। গ্যাবো তাঁর দাদুকে ডাকতেন ‘পাপালেও’ বলে।
বিশ্বসাহিত্যের আরেক কিংবদন্তী ফ্রানৎজ কাফকার বিশেষ অনুরাগী ছিলেন মার্কেজ। ১৯৪৭ সালে গ্যাবো ‘ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব কলম্বিয়া’য় আইনে ভর্তি হন বাবার ইচ্ছায়। সেখানেই প্রথম পরিচয় হয় কাফকার সাহিত্যের সাথে, ‘লা মেটামরফোসিস’ বা ‘রূপান্তর’-এর মাধ্যমে। বিষয়বস্তু না, কাফকার লেখার ধরণ তাঁকে আন্দোলিত করে, যেন শৈশবের দিদা-দাদুর কাছ থেকে শোনা গল্পগুলো ফিরে আসে তাঁর কাছে।
এরপর থেকেই মার্কেজ সিরিয়াস সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন এবং কিছুদিন পর ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকায় ‘তৃতীয় পদত্যাগ’ নামে একটি গল্প প্রকাশিত হয়। স্কুলে থাকতেই লেখালেখির শুরু হলেও গ্যাবোর সাহিত্যিক হয়ে ওঠার শুরুটা তখন থেকে।
তাঁর প্রথম বড় কাজ, The Story of a Shipwrecked Sailor। মূলত ‘এল এসপেক্তেদোর’ পত্রিকার জন্য লেখাটি মোট চৌদ্দ কিস্তিতে প্রকাশিত হয় ১৯৫৫ সালে। কলম্বিয়া নৌবাহিনীর একটি জাহাজ চোরাচালানির পণ্যের অতিরিক্ত ভারে ডুবে গিয়েছিল। সে জাহাজের একজন নাবিক ছিলেন লুইস আলেজান্দ্রো ভ্যালেসকো। সাগরের বুকে তার বেঁচে থাকার সংগ্রাম লেখাটির মূল উপজীব্য। ১৯৭০ সালে প্রথমবারের মতো বই আকারে লেখাটি প্রকাশিত হয়।
‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ বা One Hundred Years of Solitude গার্সিয়া মার্কেজের শ্রেষ্ঠ রচনা। মূলতঃ এ উপন্যাসের জন্যই তিনি ১৯৮২ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। এ বইটি লেখার পেছনের গল্পটি ভারি চমৎকার :
আঠারো বছর বয়সে গ্যাবোর ইচ্ছে হয় তার শৈশবের দাদুর বাড়ি এবং সেই মানুষজন- আসেপাশের অনুসঙ্গ নিয়ে কিছু লিখবেন। কিন্তু কলমে লেখা আসছিলো না ঠিক যেমনটি তিনি চাচ্ছিলেন। তাই তিনি সঠিক সময়ের অপেক্ষা করতে থাকেন। অনেক বছর বাদে, তিনি তার পরিবার নিয়ে আকাপুলকো যাচ্ছিলেন গাড়ি করে। হঠাৎ তাঁর মনে হয় সেই সঠিক সময়টি এসে পড়েছে, তিনি হয়তো পেয়ে গেছেন তার লেখার সকল উপজীব্য আর ঢঙ। তিনি গাড়ি ঘুরিয়ে সোজা বাসায় ফিরে আসেন এবং লিখতে বসেন। তিনি এতোটাই নিরবিচ্ছিন্নভাবে লিখতে চেয়েছিলেন যে সব কাজকর্ম ছেড়ে দেন এবং পরিবারের খরচ মেটাবার জন্য গাড়িটি বিক্রি করে দেন।
যদিও তিনি যেমনটি আশা করেছিলেন, তার চেয়ে ঢের বেশি সময় লেগেছিলো উপন্যাসটি শেষ করতে। টানা আটারো মাস লেখার পর ১৯৬৭ সালে বইটি প্রকাশ পায়। এ পর্যন্ত পৃথিবীব্যাপী বইটি বিক্রির পরিমাণ ৩৫ মিলিয়নেরও অধিক কপি এবং অনুবাদিত হয়েছে ৩৭টি ভাষায়। গোটা বিশ্বসাহিত্যে এমন আর কোনো বই দেখা যায়নি যা প্রকাশের পরপরই পাঠকপ্রিয়তার এমন তুঙ্গে উঠতে পেরেছে।
১৯৯৯ সালে গার্সিয়া মাকের্জের লিম্ফাটিক ক্যান্সার ধরা পড়ে এবং ২০১২ সালের দিকে স্মৃতি বিলোপ হতে শুরু করে। তার দুই বছর বাদেই ২০১৪ সালের ১৭ এপ্রিল মৃত্যুবরণ করেন এই কথাশিল্পী।
গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ ১৯২৭ সালের আজকের দিনে (৬ মার্চ) উত্তর কলম্বিয়ার এরাকাতাকা শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment