জন্মশতবর্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলিঃ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, জাতিগত ভাবে আমরা ১৯৭১ সালের আগ পর্যন্ত নিজের মতো করে বলতে পারিনি যে- আমি বাংলাদেশি। এ মাতৃভূমির পরিচয়, যেখানে আমি আমার ভাষায় কথা বলবো, আমি আমার নাগরিক অধিকার নিজের মতো করে উপভোগ করবো। সে স্বপ্ন বাস্তবায়ন করার মানুষগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধু এক অন্যরকম নেতা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর জন্যে। অত্যাচারী হিংস্র পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে অধিকার হিসেবে সে সর্বোচ্চ স্বস্তির জায়গা ‘আমার দেশ বাংলাদেশ’ এই বাক্যটিকে বাঙালীর অর্জনে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন দেশপ্রেমের চেতনায় ভরা, নিজস্ব ব্যক্তি স্বতন্ত্রে বলিয়ান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি শুধু যে একজন আলাদা স্বতন্ত্রের ব্যক্তিত্বই ছিলেন না, তিনি যেন একটি ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠান। একাধারে বিদ্রোহী, অন্যায়ের সাথে আপোষহীন, স্বপ্নের ঠাসা বুননে একজন মানুষ, একজন স্থপতি একটি জাতির।
আত্মত্যাগী একজন মানুষ, অবিশ্বাস্য সাহসী ও বীরত্বের অপরিসীম একটি পূর্ণাঙ্গ ইতিহাসও বলা যায় নির্ধিদ্বায়। যাকে সাধারণ মানুষ ‘বঙ্গবন্ধু’ নামীয় ভালোবাসায় সিক্ত একটি নাম উপহার দিয়েছিল সবসময়ের জন্য। মানুষের অধিকার আদায়ে শান্ত এবং বলিষ্ঠ কণ্ঠের অধিকারী শেখ মুজিব সবসময় সোচ্চার ছিলেন। ১৯৩৯ সালে যখন তিনি গোপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলের ছাত্র ছিলেন, অকুতোভয় শেখ মুজিবের নেতৃত্বে এ বছরই বিদ্যালয় পরিদর্শনে আসা তদানীন্তন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী পরবর্তীতে বাংলার প্রধানমন্ত্রী শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনকারী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কাছে বিদ্যালয়ের ভাঙ্গা ছাদ সংস্কার এর দাবী বহনকারী ছাত্রদের নেতৃত্ব দিয়ে শুরু বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক বর্ণাঢ্যময় প্রতিবাদী জীবন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাশ করে ‘৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন শেখ মুজিব। সে বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিনের দেয়া ঘোষণা- পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। তার প্রতিবাদ স্বরূপ বাঙালীর রাষ্ট্র ভাষা বাংলা হবে এই অধিকার প্রতিষ্ঠায় ছাত্র- রাজনীতিবিদদের নিয়ে ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ বলে আলোড়ন তুলেন বঙ্গবন্ধু।
সে সময় শাসক গোষ্ঠীর অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলার পরিণামে গ্রেফতার এবং কারাবরণ করেন তিনি। ১৯৪৯ সালে বিশ্ববিদ্যালইয়ের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ন্যায্য দাবী আদায়ের সংগ্রামে একাত্মতা ঘোষণার ফল স্বরূপ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে জরিমানা করে। আপোষহীন তরুণ শেখ মুজিব তা দিতে বিরত থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নের জবাবে, তার অংশগ্রহণ ন্যায্য এবং সঠিক পথেই ছিলেন বলে নিজ সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। পরবর্তীতে এর জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়। পূর্ব বাংলার পূর্নাঙ্গ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আদায়ে ১৯৬৯ সালে তারই ঐতিহাসিক সৃষ্টি ‘ছয় দফা’ এর জন্য তাঁকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। পরবর্তীতে জনগণের দুর্বার আন্দোলনের মুখে তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের আহ্বানে অনুষ্ঠিত একটি সর্বদলীয় সম্মেলনে মুজিব তাঁর ছয়-দফাসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের চাহিদাগুলো মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান এবং তা প্রত্যাখ্যাত হলে সম্মেলন থেকে বের হয়ে আসেন প্রতিবাদী শেখ মুজিব।প্রায় নয়মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর অর্জিত হয় আমাদের বিজয়। বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে ‘বাংলাদেশ’।
জনগণকে আশা এবং ভালোবাসায় ভরিয়ে রাখা, জনগণের স্বপ্নকে বাস্তবিক রূপ দেয়া, জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নিজেকে উজাড় করে দেয়া, আমৃত্যু অন্যায়ের সাথে আপোসহীন সে অবিসংবাদিত মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি দল শেখ মুজিবের বাসভবনে গিয়ে একটি অভ্যুত্থান সংঘটিত করে তাঁকে সপরিবারে হত্যা করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের আজকের দিনে (১৭ মার্চ) গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment