ব্রিটিশ ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠাতা মানবেন্দ্রনাথ রায় উপমহাদেশের অন্যতম বিপ্লবী হিসেবে পরিচিত।
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, মানবেন্দ্রের পিতৃদত্ত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। বিপ্লবী কাজে তিনি অসংখ্য ছদ্মনাম গ্রহণ করেন। এর মধ্যে মি. মার্টিন, মানবেন্দ্রনাথ, হরি সিং, ডা. মাহমুদ, মি. হোয়াইট, মি. ব্যানার্জী উল্লেখযোগ্য। তবে মানবেন্দ্রনাথ রায় (এমএন রায়) নামটি বেশি পরিচিত। গ্রেফতার এড়াতে সানফ্রান্সিসকোতে এ নাম গ্রহণ করেন তিনি। মানবেন্দ্র জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় (অরবিন্দ ঘোষ প্রতিষ্ঠিত) থেকে এন্ট্রান্স পাস করেন। তারপর বেঙ্গল টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটে প্রকৌশল ও রসায়ন শাস্ত্রে অধ্যয়ন করেন। সে সময়ে গুপ্ত বিপ্লবী দলের সঙ্গে সুন্দরবন এলাকায় পরীক্ষামূলকভাবে বোমা তৈরি ও গুলি চালানো শুরু করেন। কিছু সময় বাঘা যতীনের সঙ্গে অনুশীলন সমিতির মুখপত্র যুগান্তরে কাজ করেন। ১৯১০ সালে তিনি গ্রেফতার হন এবং তাকে ‘হাওড়া-শিবপুর ষড়যন্ত্র মামলা’র আসামি করা হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে বাঘা যতীন ও মানবেন্দ্র জার্মান সরকারের কাছে সাহায্যের আবেদন জানান। তারা জার্মান সরকারের কলকাতার প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করেন। তিনি সামরিক ও অর্থ সাহায্যের নিশ্চয়তা প্রদান করেন। মি. হোয়াইট নামে টোকিওতে সহকর্মী বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করার জন্য জাপান যান মানবেন্দ্রনাথ রায়।
মানবেন্দ্র রায় অসংখ্য বক্তৃতা ও প্রবন্ধের মাধ্যমে ভারতের পক্ষে জনমত গঠন করেন। এ সময় তিনি স্প্যানিশ, ফরাসী ও জার্মান ভাষা শেখেন। রাষ্ট্রপতির যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী অবস্থানে তিনি ছিলেন বেসরকারি উপদেষ্টা। ১৯১৮ সালের আগস্ট মাসে মানবেন্দ্র সাড়ম্বরে সোশ্যালিস্ট পার্টির সম্মেলন আয়োজন করেন। এ সময় বহু আমেরিকান সাংবাদিক, শিল্পী, কবি, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বাধ্যতামূলক সামরিক নিয়োগ এড়াবার জন্য মেক্সিকো পাড়ি জমান। রাষ্ট্রপতি কারাঞ্জা মানবেন্দ্রের জনপ্রিয়তায় খুশি হন। তিনি সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রতিনিধিরূপে একজন শ্রমমন্ত্রী মনোনয়নের জন্য মানবেন্দ্রকে অনুরোধ করেন। সে সময় লেনিনের দূত মাইকেল বরোডিন মেক্সিকো যান। তিনি মানবেন্দ্রের অতিথি হিসেবে মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতির সঙ্গে পরিচিত হন। এর ফলে মেক্সিকো ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। লেনিন ১৯২০ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে মস্কোয় অনুষ্ঠিত কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় বিশ্ব কংগ্রেসের অধিবেশনে যোগদানের জন্য মানবেন্দ্রকে আমন্ত্রণ জানান। মানবেন্দ্র মস্কোতে লেনিনের সঙ্গে দেখা করেন এবং তার ‘On National and Colonial Question’ শীর্ষক তত্ত্বের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন। লেনিন তাকে নিজস্ব তত্ত্ব প্রদানে আহ্বান জানান। উভয় তত্ত্ব নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয় এবং কংগ্রেসে উভয় তত্ত্বই একত্রে গৃহীত হয়। ১৯২১ সালের আগস্টে মানবেন্দ্র কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের তৃতীয় বিশ্ব সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯২২ সালে কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক রায়ের ‘India in Transition’ নামের বই চারটি ভাষায় প্রকাশ করে। তিনি মস্কোতে শ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯২৩ সালে নিজের সদর দফতর বার্লিনে স্থানান্তর করেন এবং ভারতের জন্য লেখনী বিপ্লব শুরু করেন। লেনিনের জীবদ্দশায় মানবেন্দ্র কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের সকল উচ্চপদ লাভ করেন। ১৯২৪ সালে লেনিনের মৃত্যুর পর তিন বছর তা বজায় থাকে। কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের চৈনিক কমিশনের যুগ্ম-সচিব হিসেবে তাকে কমিউনিস্টবাদী ও কু মিন তুংয়ের মধ্যে বিবাদ নিরসনে আলোচনার জন্য চীনে প্রেরণ করা হয়। মানবেন্দ্র ১৯৩০ সালে ড. মাহমুদ নামে ভারতে ফিরে আসেন। ১৯৩১ সালের জুলাই মাসে বোম্বাই শহরে গ্রেফতার হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে কানপুর জেলে বিচারে ১২ বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। আপিল করে দণ্ডের মেয়াদ ৬ বছর কমানো হয়। কারাগারে বসে তিনি ‘Philosophical Consequences of Modern Science’ নামে একটি বড় বই লেখেন।
১৯৩৬ সালে কারামুক্তির পর মানবেন্দ্র ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যোগ দেন এবং ‘দ্য লীগ অব র্যাডিক্যাল কংগ্রেসম্যান’ গঠন করেন। সুভাষচন্দ্র বসুকে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সভাপতি হতে সমর্থন জানান। কংগ্রেসের উচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বের সঙ্গে যুদ্ধনীতি নিয়ে মতানৈক্যের কারণে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৪০ সালে তিনি গঠন করেন র্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টি। মানবেন্দ্রনাথ রায় মার্কসবাদের সংশোধিত রূপ প্রকাশ করেন ‘Beyond Marxism’ ও ‘New Humanism’ বইয়ে। ১৯৪৭ সালে তিনি ১৯১৭ সাল থেকে রাশিয়ার ঘটনাক্রম বিশ্লেষণ করেন। ১৯৪৮ সালে র্যাডিক্যাল ডেমোক্রাটিক পার্টির বিলোপ করে ইন্ডিয়ান রেনেসাঁস ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন। এ সময় লিখেন যুগান্তকারী বই ‘Reason, Romanticism and Revolution’। এরপর জীবনস্মৃতিমূলক গ্রন্থ রচনা আরম্ভ করেন, কিন্তু সম্পন্ন করতে পারেননি। ১৯৫৪ সালের ২৪ জানুয়ারি মানবেন্দ্রনাথ রায় দেরাদুনে মারা যান।
মানবেন্দ্রনাথ রায় ১৮৮৭ সালের আজকের দিনে (২১ মার্চ) চব্বিশ পরগনা জেলার আড়বেলিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment