———————-শেষ পর্ব———————-
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা, ৯এপ্রিল ২০২০ কবি নজরুল বলেছিলেন, জাতের নামে বজ্জাতি। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। সাধারণ মানুষ তো বটেই পৌরাণিক চরিত্রেরও জাতের বিচারে পিছিয়ে নেই দেশের এক শ্রেণীর মানুষ।অধিকাংশই আবার কেন্দ্রের শাসক দলের সঙ্গে যুক্ত। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হনুমান প্রসঙ্গে বলেছেন, তিনি ছিলেন দলিত। যোগিজি নিজে উত্তরাঞ্চলের রাজপুত। কিন্তু দলিত ভোট কব্জা করতে মন্ত্রিসভায় ঠাঁই দিয়েছেন উপ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এক দলিতকে।
যোগিজির কথায় ক্ষেপে যান রাজস্থানের এক মোহন্ত রাধে শ্যাম তেওয়ারী। তিনি বলেন, শাস্ত্রে কোথায় লেখা আছে যে হনুমানজী দলিত? যোগিজির মন্তব্যেও অমিত শাহও ক্ষেপে যান। কেননা ব্রাক্ষ্মণ ধর্মসভা থেকে আইনি নোটিশ পান যোগিজি। তাঁদের বক্তব্য, হনুমানের পৈতে ছিল। তিনি ছিলেন ব্রাক্ষণ। এই মুহূর্তে বিজেপি ছেড়ে কংগ্রেসে যোগদেওয়া বিজেপি প্রাক্তন দলিত সাংসদ সাবিত্রীবাঈ ফুলে যোগিজিকে সমর্থন করে বলেছিলেন, হিন্দু ধর্মের উচ্চবর্ণের মানুষরা হনুমানের মত মুখ আর লেজ রামায়ণের লেখায় ঢুকিয়েছে। এবার এগিয়ে আসেন উত্তরপ্রদেশের বিজেপি নেতা বিনীত আগরওয়াল শারদা দাবি করেছেন, হনুমান রামের দত্তক পুত্র। জাতিতে বৈশ্য। আর এক বিজেপি মুসলিম নেতা বুক্কাল নবাব বলেন, হনুমান ছিলেন মুসলিম। যুক্তি বড় অদ্ভুত। মুসলিমদের নাম হয় সোলেমান, ওসমান। তেমন হনুমান। উত্তরপ্রদেশের আর এক বি জে পি নেতা চৌধুরী লক্ষ্মী নারায়ণ বলেন, হনুমান ছিলেন জাঠ। বিজেপি নেতা জ্ঞানদেব আহুজা বলেন, হনুমান ছিলেন ঠাকুর। সমাজবাদী পার্টির শিবশঙ্কর যাদব বলেন, হনুমান ছিলেন যাদব। বিহারের লালুজির দলের নেতা চৌধুরী সুনীল সিনহা বলেন হনুমান চাষীর বেটা। পুরাণমতে কে হনুমানের পিতা কে মাতা, কে পালিত পিতা সবই বলেছি প্রথম পর্বে। শেষ পর্বে বলবো, হনুমান নাকি চির কুমার। তাহলে বউ এর কথা আসছে কোথা থেকে?
প্রসার ভারতীর ভূতপূর্ব প্রধান কর্তা জহর সরকার বলেন, তামিল বা কেরলে বলে হনুমানের জন্ম পৌষমাস। একটা ব্যাপার পরিষ্কার জানা দরকার। হনুমান কি পবনপুত্র? ষোড়শ শতকে লেখা একনাথের ভাবার্থ রামায়ণে যেমনটি লেখা আছে। নাকি হনুমান চল্লিশার কথাই ঠিক। তিনি শিবের ছেলে? এই প্রসঙ্গে সিন্ধু সভ্যতায় রাম বা হনুমানের কোন উল্লেখ নেই। বেদেও তাদের দেখা মেলে না। রামের লঙ্কা অভিযানের কাহিনী এসেছে অনেক পরে। প্রসার ভারতীর প্রাক্তন প্রধান জহর সরকারের বক্তব্যে, হনুমান দলিত ছিলেন তার একটা সূত্র মিলেছে। বস্তুত, দক্ষিণ ভারতের গত শতাব্দীর মাঝামাঝি উত্তর ভারতের ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে আন্দোলন হয়, তার নায়ক পেরিয়ার এবং তাঁর অনুগামীরা প্রবল অভিযোগ করেছিলেন যে, রামায়ণে দক্ষিণ ভারতের অপমান করা হয়েছে। ধীরেন্দ্রনাথ বাস্কে বলেছেন, রামায়ণের হনুমান আসলে ওঁরাও আদিবাসী। একসময় তারা পশ্চিম ভারতের গুজরাট, কঙ্কন ইত্যাদি স্থানে বাস করত। পরে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় তারা জীবিকার সন্ধানে প্রথমে উত্তর ভারতে আসে। তারপর বিহারের সাহাবাদ জেলায় বসবাস করতে শুরু করে। যা এখন ঝাড়খণ্ডে। পুরাণ তথ্যও বলেছে , হনুমানের জন্ম পাহাড়ের গুহায়। এখনকার এক মন্দিরে শিশু হনুমান অঞ্জনা কোলে – এমন একটি মূর্তি আছে। অনেকটাই মাতা মেরির কোলে যীশু মূর্তির মতো। ঝাড়খন্ডীদের বিশ্বাস, এখানকার প্রাচীন পুজো শিব পুজো। হনুমান জননী অঞ্জনা প্রতিদিন শিব মূর্তির পুজো করতেন। হনুমানের জন্মদিন যেমন কবে তা নিয়ে বিতর্ক, তেমনই বিতর্ক হনুমানের জন্মস্থান নিয়ে। অনেকে বলেন, নাসিক জেলায় ত্রিম্বাকেশ্বরে অঞ্জন একটি ছোট গ্রাম । গুমলা থেকে ১৮ কিমি দূরে একটি মন্দির গড়ে উঠেছে হনুমানের জন্মস্থান মনে করে। আবার কেউ বলেন, কর্নাটকে ঋষি্উহ্য পর্বত যা পম্পা নদীর তীরে। সেখানেই নাকি হনুমানের জন্ম। সবশেষে বলি হনুমান ভক্তরা বলেন হনুমান নাকি চিরকুমার। ব্রহ্মচারী। কিন্তু ঋষি পরাশর বলেছেন, সূর্যকন্যাকে নাকি আপত্তি সত্ত্বেও বিয়ে করতে হনুমান বাধ্য হন গুরুদক্ষিণার ঋণ শোধ করতে। আবার রামায়ণের জৈন সংস্করণ ‘পৌমাচারিয়’ বা ‘পদ্মচরিত’ রচয়িতা বিমলা সুরি বলেছেন, হনুমান ব্রহ্মচারী নন। তিনি রাক্ষস খর-দূষণের কন্যা অনঙ্গকুস্থমাকে বিয়ে করেছেন । পরে রাবণ নাকি তাঁর এক ভ্রাতুষ্পুত্রীর সঙ্গে হনুমানের বিয়ে দেন। পরাশর সংহিতা মতে , কিশোর হনুমান শিক্ষালাভের জন্য যান সূর্যের কাছে। সূর্য তাঁকে বেদ, বেদাঙ্গ, উপনিষদ শেখান । কিন্তু অবিবাহিত হওয়ায় নব বৈয়াকরণ বা ব্যাকরণের নয় সূত্র অধ্যয়নের যোগ্য ছিলেন না। সমস্যা মেটাতে সূর্য এক সুন্দরী সৃষ্টি করেন। তার সঙ্গে মিলিত হওয়ায় হনুমানের ব্রহ্মচর্য নষ্ট হয়।
তিনি তাঁর পাঠ সম্পূর্ণ করেন । অন্ধ্রপ্রদেশে একটি মন্দিরে হনুমানের সঙ্গে তাঁর স্ত্রীরও মূর্তি আছে। স্ত্রীর নাম শুভ্রর্লা। একসঙ্গে দুজনকে বলা হয় বলে শুভ্রর্লা-অঞ্জনেয়। জৈষ্ঠ্যমাসের শুদ্ধ দশমীর দিন বুধবার হনুমান বিয়ে করেন শুভ্রর্লাকে। জৈনমতে, হনুমানের বর্ণনায় বলা হয় সমগ্র লঙ্কাকে জ্বালিয়ে যখন সমুদ্রে ডুব দেন তাঁর দেহের ঘাম(?) একটি বড় মাছ খায়। জন্ম হয় পুত্র মকরধ্বজের । হনুমানকে দেবতা জ্ঞানে পুজো করলেও তার কোন বাহন নেই। অনেকটা কি বিফলেস ব্যারিস্টারের মতো?
Be First to Comment