#হারানো দিনের কথামালা#
প্রবীর রায় : চলচ্চিত্র প্রযোজক, পরিচালক ও অভিনেতা।১০ জুন ২০২৪। আরেকটা সোনা দিয়ে বাঁধানো স্মৃতি যেদিন শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্র জীবনীকার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ পদ্মভূষণ প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়ের বাড়ি গিয়েছিলাম। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে আমার দাদু হন। দাদু মানে আমার জেঠিমার আপন মেসো ! জেঠীমার মা ছয় বোন ছিলেন। জেঠিমার মা শোভাময়ী, ব্রাহ্মসমাজের আচার্য্য সীতানাথ তত্ত্বভূষণের তৃতীয় সন্তান ! পরের বোন সুধাময়ী (প্রভাত দাদুর স্ত্রী) আর সব ছোট বোন ছিলেন বকুল ! বকুল দিদা ছিলেন বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও শিক্ষক সুবিনয় রায়ের মা ! শোভাময়ী আর সুধাময়ী দুজনেই শিক্ষিকা আর দীনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের ছাত্রী ছিলেন !
এইজন্যে আমি ওঁনাকে ‘প্রভাত দাদু’ বলে ডাকতাম। আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো ওনার নামই শোনেনি !
১৯৭৭-৭৮ এর কথা। আমি গেছি শান্তিনিকেতনে নব্যেন্দু চট্টোপাধ্যায় পরিচালিত ‘আজ কাল পরশুর গল্প” র ছবির শুট করতে। আর আমার বন্ধু গৌতমও (প্রখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী গৌতম মিত্র Goutam Mitra ) তখন শান্তিনিকেতনে ও গিয়েছিল ঢুলুদার (চিত্র পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়) ছবি “পাকা দেখা”-তে একটা ছোট ভূমিকায় অভিনয় করার জন্য। পাকা দেখা ছবির প্রোডিউসার ছিলেন আমাদের বন্ধু অর্নব। ও এখন আর নেই।
ওরা ছিল গভর্নমেন্ট গেস্ট হাউসে আর আমরা ছিলাম টুরিস্ট লজে। গৌতম তখন রবীন্দ্রসঙ্গীত, পুরাতনী গাইছে, খুব ভাল গাইতো। ও আর ইন্দ্রাণী সেন তখন রবীন্দ্রসঙ্গীতে বেশ নাম করেছে।
একদিন গৌতম আমাকে বলল- “আমার সঙ্গে একবার প্রভাত মুখোপাধ্যায়ের আলাপ করিয়ে দে না।“ আমি বললাম, “ঠিক আছে, নিয়ে যাব।“ প্রভাত দাদু তখন থাকতেন পাশেই, ভুবনডাঙ্গায়। গেলাম। গৌতমের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিলাম। আলাপচারিতা, কুশল বিনিময় হলো। গৌতম যে রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়, প্রভাতদাদুকে বললাম। বললেন, “একটা গান শোনাও।“ ওঁর বাড়িতে হারমোনিয়াম ছিল না। গৌতম একটু দ্বিধা করছে দেখে দাদু জিজ্ঞেস করলেন, “কী? বাদ্যযন্ত্র লাগবে?”
প্রভাতদাদুর চার ছেলে- সুপ্রিয় মুখোপাধ্যায় (এখন বেঁচে নেই), চিত্তপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, দেবপ্রিয় মুখোপাধ্যায়, বিশ্বপ্রিয় মুখোপাধ্যায়। বড় বৌমা সাহানা মামী খুব ভাল এসরাজ বাজাতেন। দাদু বড় বৌমাকে ডাকলেন, “সাহানা, একটু এসরাজটা ধরো তো।“
গৌতম সেদিন দুটো গান শুনিয়েছিল। “তোমারেই করিয়াছি জীবনের ধ্রুবতারা” আর “আমি তোমার সঙ্গে বেঁধেছি আমার প্রাণ”। অত্যন্ত সৌম্য দর্শন প্রায় গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে প্রভাত দাদু ইজিচেয়ারে বসেছিলেন চোখ বুঁজে।
গান শেষ হলে চোখ খুলে বললেন, “সাধু, সাধু, তোমার হবে। তুমি অন্তর থেকে খুব আবেগ দিয়ে গান করো। তুমি খুব বড় শিল্পী হবে ! তোমার উপর গুরুদেবের আশীর্বাদ আছে।“ তারপর মিষ্টিমুখ করে সবাইকে প্রণাম করে আমরা ফিরে এলাম। গৌতমও বোধহয় সেই দিনটা আজও ভুলতে পারেনি !
এও জীবনের আরেক অমূল্য স্মৃতি……।
Be First to Comment