Press "Enter" to skip to content

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৬০তম জন্মদিনে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় জীবন ও মৃত্যু……….

Spread the love

ড.বিবেকানন্দ চক্রবর্তী: রাষ্ট্রপতি-পুরস্কারপ্রাপ্ত জাতীয় শিক্ষক ও রবীন্দ্র গবেষক, ৮মে ২০২০।বৈদূর্যমণিতে যেমন সূর্যরশ্মি বিচ্ছুরিত হয়, জীবন ও মৃত্যুর স্বরূপও আমাদের কাছে উদ্ঘাটিত। বিশেষত রবীন্দ্রনাথের কবি চিত্তে এই বিষয়টি উদ্ভাসিত হয়ে রঙে-রসে-ব্যঞ্জনায় রৌদ্র দীপিত কমলিকার মত অভিব্যক্তি লাভ করেছে।
জীবনের উপলব্ধি মৃত্যুকে দূরে রেখে নয় মৃত্যুকে সাথে গ্রহণ করে। কারণ জীবন ও মৃত্যু পারস্পরিক গ্রন্থি বন্ধনে সমন্বিত। যে মৃত্যুকে কবি দয়িতরূপে, পরানবধূরূপে সম্বোধন করেছেন তার সঙ্গে অন্বিত হওয়ার জন্য কবি কল্পনা করলেন এই নশ্বর দেহ অগ্নিময় হয়ে উঠবে হয়ে উঠবে তখন মর্ত্য বাঁধন ছিন্ন হয়ে যাবে। এই বিশ্বসংসারের মূল উৎস আনন্দ। আনন্দের অমৃত ধারায় অবগাহন করেই এই বিশ্ব সৃষ্টির বিবর্তন। নানাবিধ ব্যঞ্জনার মধ্য দিয়ে এই আনন্দরস নিত্য প্রবহমান। প্রতিটি মানুষের মধ্যে এই আনন্দের স্বরূপ না জেনেও আনন্দরস আস্বাদনের জন্য, আনন্দ হওয়ার জন্য একটা অস্পষ্ট আকুলিভাব দেখা যায়। কিন্তু মাঝে একটি আবরণের ফলে, চিত্তের স্বচ্ছতার অভাবে এই অনুভব তার মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশিত হয় না। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, যিনি ক্রান্তদর্শী তাঁর স্বাত্ত্বিক দৃষ্টির ব্যঞ্জনায় এই আনন্দরস তাঁর অনুভবে অনন্ত বৈচিত্রে ‘অধরা মাধুরী’-তে ধরা পড়ে। কবির সৃষ্টি সেই অনুভবেই বাঙ্ময় প্রকাশ যা দেশ-কাল-দেহ এর সীমাকে অতিক্রম করে।
উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘আনন্দাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে, আনন্দেন জাতানি জীবন্তি, আনন্দং প্রয়ন্ত্যভিসংবিশন্তি’। অর্থাৎ আনন্দ থেকে বিশ্ব উদ্ভূত হয়, আনন্দেই স্থিত থাকে এবং আনন্দে বিলীন হয়ে যায়। এই আনন্দ চৈতন্যস্বরূপ, আনন্দই রসস্বরূপ।

আমাদের জীবন তাই আনন্দেই প্রতিষ্ঠিত। প্রশ্ন আসতে পারে, যদি জীবনের প্রতিষ্ঠা আনন্দে, তবে দুঃখবোধ আসে কেন? এর উত্তর হলো এই, অনন্তসত্ত্বাকে খন্ড ও বিচ্ছিন্ন করে দেখার ফলে দুঃখবোধের সৃষ্টি হয়। উপনিষদে বলা হয়েছে, ‘যদল্পং তন্মর্ত্যম্‌’ যা অল্প বা ক্ষুদ্র তা মরনধর্মী, ‘ভূমৈব সুখম্‌’ যা ভূমা তা সুখ। মর্ত্যজীবনের প্রতিটি আনন্দকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তার পরিণতি হলো দুঃখ। প্রাপ্তিক্ষণে কোন বস্তু যে ব্যঞ্জনায় উদ্দীপ্ত হয়ে সুখের কারণ হয় বস্তুর বিয়োগের সম্ভাবনাও চিত্তে দুঃখের আবেশ আনে। এইজন্য জাগতিক বস্তু আমাদের অন্তহীন সুখের সন্ধান দিতে পারে না। পার্থিব ভোগপ্রকরণ দিয়ে মানুষের আনন্দ সার্থক হয় না। পার্থিব ভোগ বারবার শেষ হয়ে যায়, আর ভোগের সঞ্চয় এর জন্য সে অসীম সত্ত্বা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, এই কারণে তার দুঃখ ভোগের অন্ত থাকে না। কিন্তু আনন্দের অমৃতময় উৎস সেই তেজময় অমৃতময় সত্ত্বাটি যখন তার জীবনের সঙ্গে একীভূত করে অনুভবে প্রতিভাসিত হবে, তখন আর দুঃখবোধ বা বিচ্ছেদ ব্যথা থাকবে না। রবীন্দ্রনাথ বলেছেনঃ-
হে অনির্বচনীয় অনন্ত, তোমাকে রসময় বলে দেখলে সমস্ত চিত্ত একেবারে সকলের নিচে নত হয়ে পড়ে।… তোমার যে রস হাটবাজারে কেনবার নয়, রাজভান্ডারে কুলুপ দিয়ে রাখবার নয়, যা আপনার অন্তহীন প্রাচুর্যে আপনাকে আর ধরে রাখতে পারছে না, চার দিকে ছড়াছড়ি যাচ্ছে—তোমার যে-রসে মাটির উপর ঘাস সবুজ হয়ে আছে, বনের মধ্যে ফুল সুন্দর হয়ে আছে— যে-রসে সকল দুঃখ, সকল বিরোধ, সকল কাড়াকাড়ির মধ্যেও আজও মানুষের ঘরে-ঘরে ভালোবাসার অজস্র অমৃতধারা কিছুতেই শুকিয়ে যাচ্ছে না, ফুরিয়ে যাচ্ছে না— মুহূর্তে-মুহূর্তে নবীন হয়ে উঠে পিতায়-মাতায়, স্বামী-স্ত্রীতে, পুত্রে-কন্যায়, বন্ধু-বান্ধবে নানা দিকে নানা শাখায় বয়ে যাচ্ছে—সেই ভোমার নিখিল রসের নিবিড় সমষ্টিরূপ যে-অমৃত তারই একটু কণা আমার হৃদয়ের মাঝখানটিতে একবার ছুঁইয়ে দাও।

(বিশ্ববোধ, শান্তিনিকেতন)
সীমার মধ্য দিয়েই রবীন্দ্রনাথ উপলব্ধি করেছেন অসীমের সত্ত্বাকে। কবি বলেছেন, ‘সীমাহীনতার প্রতি আমাদের একটা প্রবল আকর্ষণ আছে, সেই আকর্ষণই আমাদের জীবনকে গতি দান করে। সেই আকর্ষণকে অবহেলা করিয়া নিশ্চেষ্ট হইয়া বসিয়া থাকিলে মঙ্গল নাই, ভূমাকে আমাদের পাইতেই হইবে, সেই পাওয়াতেই আমাদের সুখ’। (পথের সঞ্চয়)। ‘হিরন্ময়েণ পাত্রেণ সত্যস্যাপিহিতং মুখম্‌’ হিরন্ময়পাত্রের দ্বারা সত্যের মুখটি আবৃত। তাই এই সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে। উপেয়কে পেতে হলে উপায় আবশ্যক। কবি উপলব্ধি করেছেন, চিত্ত যখন কলুষিত থাকে তখন পরম সত্যটি উদ্ঘাটিত হয় না। লোভ, ক্রোধ, অহমিকা প্রভৃতি ‘ধুলিকর্দম’, যা পরমজ্যোতির প্রবেশদ্বার রুদ্ধ করে। আমাদের দর্শনশাস্ত্রেও বারবার চিত্তদর্পণের মার্জনা করার কথা বলা হয়েছে। চিত্তদর্পণ সম্পূর্ণ ভাবে নির্মল হলেই অন্তরজ্যোতির প্রকাশ হয়। এজন্য সত্যদৃষ্টির দ্বারা আমরা যা লাভ করি তার সঙ্গে যোগ। আমাদের অনন্ত জীবনের। কবি জীবনের পূর্ণতার বিকাশে বিশ্বাসী। এজন্য স্বার্থপরতা, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা থেকে নিজেকে মুক্ত করতে পারলেই পরম প্রেমাস্পদের সন্ধান পাওয়া যাবে। কী গাহিবে, কী শুনাবে! বলো, মিথ্যা আপনার সুখ, মিথ্যা আপনার দুঃখ। স্বার্থমগ্ন যেজন বিমুখ বৃহৎ জগৎ হতে সে কখনো শেখেনি বাঁচিতে। মহাবিশ্বজীবনের তরঙ্গেতে নাচিতে নাচিতে নির্ভয়ে ছুটিতে হবে, সত্যেরে করিয়া ধ্রুবতারা, মৃত্যুরে না করি শঙ্কা। দুর্দিনের অশ্রুজলধারা মস্তকে পড়িবে ঝরি—তারি মাঝে যাব অভিসারে তার কাছে, জীবনসর্বস্বধন অর্পিয়াছি যারে জন্ম জন্ম ধরি। কে সে? জানি না কে। চিনি নাই তারে— শুধু এইটুকু জানি—তারি লাগি রাত্রি-অন্ধকারে।
চলেছে মানবযাত্রী যুগ হতে যুগান্তর-পানে।
ঝড়ঝঞ্ঝা-বজ্রপাতে, জ্বালায়ে ধরিয়া সাবধানে
অন্তরপ্রদীপখানি। সমস্ত বিশ্বের মধ্যে পরম ঐশ্বর্যময় ঈশ্বর, তাঁর অনন্ত প্রেমে অনন্ত মাধুর্যে নিজেকে প্রকটিত করেন। কেবলমাত্র নিষ্কলুষ চিত্তে এই একাত্মতা ধরা পড়ে। ব্ৰহ্মকে জানতে হলে কবির মতে ‘তনুকে ভগবতী তনু’ করে তুলতে হবে। ক্ষুদ্র অহংবোধ থেকে বিমুক্ত হতে পারলে বিশ্বের মিলনমালার সঙ্গে গ্রথিত হওয়া যাবে।
এখন রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু সম্বন্ধে আলোচনা করব। জীবনের প্রাণস্পন্দন যখন স্তব্ধ হয়ে যায়, তখনই তাকে জাগতিক দৃষ্টিতে বলা হয় মৃত্যু। প্রাচীন যুগ থেকে মানবমনে এ বিষয়ে অনন্ত জিজ্ঞাসা উদিত হয়েছে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ভয়ঙ্কর পরিণাম চিন্তা করে অর্জুন মোহগ্রস্ত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনের মোহ ভঙ্গ করে বলছেন—
অব্যক্তাদীনি ভূতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত।
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।। গীতা, ২।২৮ অর্থাৎ মনুষ্যজন্মের প্রাক্-অবস্থিতি অব্যক্ত, মনুষ্যজন্মের পশ্চাৎ-অবস্থিতি অব্যক্ত। শুধু এই বর্তমান জীবনটি ব্যক্ত, তাই যা অব্যক্ত তার জন্য শোক কেন? প্রাচীন ঋষিদের ভাবধারায় অবগাহন করে পরিশীলিত মননের সৌকর্যে রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু নানা ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।

ব্যক্তিজীবনে তাঁর বিভিন্ন প্রিয়জনের মৃত্যু তাঁর চিত্তকে গভীর ভাবে আন্দোলিত করেছে। নানা বিবর্তনের মধ্যে দিয়ে মৃত্যু তাঁর কাছে কখনও ‘সকরুণ ছন্দ’, কখনও ‘বিহ্বলতা’, কখনও ‘শ্যামসুন্দরের রূপ’, কখনও ‘বিচ্ছিন্ন নটরাজের লীলা’। আবার কখনও মৃত্যু অখণ্ড সত্য, কখনও সে পরম প্রিয়তম পরাণবঁধু। পরম প্রিয়তমকে উদ্দেশ্য করে ‘ভানুসিংহের পদাবলী’তে কবি শোনালেন—
মরণ রে, তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
মেঘবরণ তুঝ, মেঘজটাজুট
রক্তকমলকর, রক্ত-অধরপুট
তাপবিমোচন করুণ কোর তব
মৃত্যু-অমৃত করে দান।
তুঁহুঁ মম শ্যামসমান।
কবির দৃষ্টিতে মৃত্যু ও জীবন পরস্পর বিরুদ্ধ নয়, কিন্তু একটি অপরটিকে অপেক্ষা করে। জীবন ও মৃত্যু একটি অনন্তধারা। দুঃখ ও মৃত্যু যেমন সত্য, শান্তি ও আনন্দ তেমনই সত্য। বিচ্ছেদ শুধু খণ্ড কালের। ফুল যেমন জাগতিক নিয়মে ঝরে যায়, তেমনি এই দেহেরও বিনাশ আছে। সীমায়িত দৃষ্টিতে মৃত্যু দুঃখরূপে অনন্ত শোকের প্রতীক, তা অপরিসীম বিরহব্যথায় চিহ্নিত। কিন্তু সীমাতীতরূপে মৃত্যু অমৃতের প্রতিরূপক। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন ‘সেইজন্যই মৃত্যুর ডাক আর-কিছুই নহে, সেই বাসাবদলের ডাক। জীবনকে কোনোমতেই সে কোনো সনাতন প্রাচীরের মধ্যে বদ্ধ হইয়া থাকিতে দিবে না।

জীবনকে সেই জীবনের পথে অগ্রসর করিবে বলিয়াই মৃত্যু’। (পথের সঞ্চয়)। ‘ব্যক্তি হিসেবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা উৎকট এবং তার মধ্যে কোনো সান্ত্বনা নেই। কিন্তু বিশ্বজগতের হিসাবে দেখতে গেলে মৃত্যুটা অতি সুন্দর ও মানবাত্মার সান্ত্বনাস্থল’। (ছিন্নপত্রাবলী)
এই ভাবে কবি প্রজ্ঞার আলোকে দেখেছেন মৃত্যুর রূপ, যেখানে তাঁর দর্শনে জীবন ও মৃত্যুর একটা সমন্বয় সাধিত হয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে এ দুয়ের মধ্যে বিপরীতধর্মিতা থাকলেও কবির চেতনায় মৃত্যু নির্মল প্রাণশক্তির দ্যোতক। অনন্ত জীবনের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সাধনায় কবিমানসে জীবন ও মৃত্যুর আর বিভেদের প্রয়োজন হয় না। মোহিতলাল মজুমদার একটি উপমা প্রয়োগে কবির মৃত্যুচেতনা বিষয়ে বলেছেন যে, এই যে-মৃত্যু—এ মৃত্যু রসপিপাসার গুঞ্জরণ শেষে মধুপানে নীরব হওয়ার মৃত্যু, এ অবস্থা মানুষের সাধারণ অবস্থার অতীত যা বাক্যের দ্বারা বোধগম্য করা যায় না… রবীন্দ্রনাথ এখানে কবি নয় মিস্টিক রসের সাধক… এই অবস্থায় জীবনের প্রতি মমতা এবং এরই ফলে মৃত্যুকে আড়ালে রাখবার প্রয়োজন নেই। গভীর মানবতাবোধ ও পূর্ণতার অনুভূতি দিয়ে কবি উপলব্ধি করেছেন—অখণ্ড তাই মানুষের আশ্রয়; পূর্ণের দৃষ্টিতে বিয়োগ নেই, বিচ্ছেদ নেই, এইজন্য কবির চেতনায় মৃত্যু ‘শ্যামসমান’। অনবদ্য ছন্দে ও ভাষার মাধুর্যে ‘ঝুলন’ কবিতার মধ্যেও এই ভাবটি পরিস্ফুট হয়েছে যে, মৃত্যুর মধ্যে দিয়ে আসবে পরম প্রেমাস্পদের সঙ্গে নিবিড় পরিচিতি। তাই কবি বলেছেন ‘মরণদোলায় ধরি রশিগাছি / বসিব দুজনে বড় কাছাকাছি’, অপর একটি ভাবও এই কবিতায় পরিস্ফুট হয়েছে তা হল অনন্ত সত্ত্বার সঙ্গে ব্যক্তি-সত্ত্বার মিলনের আকুতি। মৃত্যু তাঁর কাছে যেমন পরাণবঁধু, অনন্ত সত্ত্বাও তাঁর দৃষ্টিতে পরাণবঁধু। এই অনন্তের উদ্দেশে কবির উক্তি—
তুমি যদি বক্ষোমাঝে থাক নিরবধি,
তোমার আনন্দমূর্তি নিত্য হেরে যদি
এ মুগ্ধ নয়ন মোর,—পরাণবল্লভ,
তোমার কোমলকান্ত চরণপল্লব
চিরস্পর্শ রেখে দেয় জীবনতরীতে,—
কোনো ভয় নাহি করি বাঁচিতে মরিতে।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.