বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ১৯২৫ সালের কাছাকাছি সময়। কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে হঠাৎ পটচিত্রগুলোর উপরে চোখ পড়ল তরুণ শিল্পী যামিনী রায়ের। কালী চরিত্র এবং কাহিনি তুলির টানে, উজ্জ্বল রঙের ব্যবহারে নিপুণ ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শিল্পী। যেন ধাক্কা খেলেন। ‘ইম্প্রেশনিজম’ এবং ‘কিউবিজম’-উত্তর সময়ে শিল্পের এই সারল্য তাঁকে মুগ্ধ করল। চিত্রশিল্পকে জাদুঘরের দেওয়াল থেকে মধ্যবিত্তের গৃহস্থালিতে পৌঁছে দেওয়া শিল্পী যামিনী রায়ের জন্ম ১৮৮৭ সালের ১১ এপ্রিল। বাঁকুড়ার বেলিয়াতোড়ের একটি সম্পন্ন পরিবারে। তাঁর পিতা রামতরণ রায়ও ছিলেন শিল্প অনুরাগী। সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন শুধু শিল্পকর্মে মনোনিবেশ করবেন বলে।
যামিনী রায় মাত্র ১৬ বছর বয়সে বেলিয়াতোড় থেকে কলকাতায় যান। শিল্প শিক্ষার জন্য ভর্তি হন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। সেই সময় ওই প্রতিষ্ঠানের ভাইস-প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর। এই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজেই ‘ক্লাসিকাল আর্ট ফর্ম’ নিয়ে পড়াশোনা করেন যামিনী। ১৯০৮ সালে ফাইন আর্টসে ডিপ্লোমা সম্পূর্ণ করেন। এর পরে সামান্য পারিশ্রমিকের বিনিময়ে ‘পোর্ট্রেট ড্রয়িং’-এর মাধ্যমে দিনযাপন করতে শুরু করেছিলেন। দিন কেটে যাচ্ছিল। কিন্তু যামিনী জানতেন, কোথাও কোনও শূন্যস্থান রয়ে যাচ্ছে। ঠিক পথের সন্ধান না পেয়ে থমকে রয়েছে তাঁর নিজস্ব সৃষ্টি। সেদিন কালীঘাট মন্দিরের আশপাশে ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ সেই পথের সন্ধান পেয়ে গেলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন, বাংলার লোকশিল্পকেই পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করবেন। দৈনন্দিন বঙ্গজীবন অতি সহজেই ধরা দিল শিল্পীর তুলিতে। আর এই সহজবোধ্য শিল্প সহজলভ্য হয়ে উঠল বঙ্গবাসীর কাছে। পৌঁছে গেল মধ্যবিত্তের অন্দরে। তাঁর নব অনুরাগ বাংলার লোকশিল্পে, সংস্কৃতিতে, লোকপুরাণে। লোকজ ছন্দ ও স্পন্দনে। তাঁর ছবির ফ্রেমে বাংলার উদ্ভিদজগৎ, প্রাণিজগৎ, প্রাকৃতিক জগৎ ধরা পড়ল। তবে এ সব তিনি মূলত খুঁজে পেলেন বাংলার পটচিত্রে। আটপৌরে, জাঁকজমকহীন, প্রসাধনহীন সারল্য ভরা রেখা-রং থাকে তাঁর ছবিতে। তৈরি করেন সারি সারি রামায়ণ কথা, সাঁওতাল জীবন যাপন, কৃষ্ণলীলা। চরিত্রের আশ্চর্য চোখ দর্শককে স্থির করে দেয়।
১৯৩০ সালের শুরুর দিক থেকে যামিনী রায় পটুয়া শিল্প আহরণ করে শহুরে শিল্পজগতে নিজস্ব জায়গা প্রায় পাকা করে ফেললেন। ব্রিটিশ কলকাতার রাস্তায় এই প্রথম প্রদর্শিত হল কোনও ভারতীয় শিল্পীর আঁকা ছবি। তাঁর আঁকা ছবির দাম এতটাই কম ছিল যে, মধ্যবিত্ত ভারতীয়দের নাগাল পেতে অসুবিধা হল না। ক্রমে পাশ্চাত্য দুনিয়াও তাঁর শিল্পের সন্ধান পেল। আগামী বছরগুলোয় যামিনী রায়ের আঁকা ছবির প্রদর্শনী হল নিউ ইয়র্কে এবং লন্ডনে। বর্তমানে পৃথিবীর একাধিক আর্ট মিউজিয়ামে যামিনী রায়ের ছবি রাখা রয়েছে।
১৯৫৪ সালে পদ্মভূষণে সম্মানিত হন এই শিল্পী। ১৯৫৫ সালে ললিতকলা অ্যাকাডেমির ‘ফেলো’র সম্মান দেওয়া হয় তাঁকে।
যামিনী রায় ১৯৭২ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
Be First to Comment