নিজস্ব প্রতিনিধি : কলকাতা, ১২ই মার্চ, ২০২৪। এই বছর বিশ্ব কিডনি দিবস উপলক্ষ্যে গত ১২ ই মার্চ, ২০২৪ তারিখে পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান বেসরকারি হসপিটাল চেন মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল তাদের মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটালে আয়োজন করেছিল কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট চ্যাম্পিয়ন্স মিট। এই আয়োজনের অন্যতম উপলক্ষ্য ছিল কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সংক্রান্ত বিভিন্ন জটিল বিষয় নিয়ে তুলে ধরার উপস্থিত সকলের মধ্যে। আলোচনায় ছিলেন (প্রফেসর) ডঃ দিলীপ কুমার পাহাড়ি, নেফ্রোলজি বিভাগের প্রধান, সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান, ডিরেক্টর এবং সিনিয়র কনসালটেন্ট, নেফ্রোলজি, মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল। এছাড়া ছিলেন ডঃ রোহিত রুংতা, কনসালটেন্ট নেফ্রোলজিস্ট এবং রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট ফিজিশিয়ান, মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল। এনারা বিভিন্ন বিভ্রান্তি দূর করেন, দরকারি তথ্য জানান এবং নেফ্রোলজিকাল ইস্যুর দিকগুলো তুলে ধরেন। এই অনুষ্ঠানে ১৫ জন মানুষের জীবনের কাহিনী তুলে ধরা হয় যারা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার পর স্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন।
এই অনুষ্ঠানে যেই আলোচনা হয়, তা মানুষকে ক্লিনিক্যাল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অবহিত করেন, যেখানে কিডনির সমস্যার উপসর্গ থেকে পুরোদস্তুর ভালো থাকার দিকটি ছিল।
নিজের জীবনের গল্প বলতে গিয়ে ৫৭ বছর বয়সী শিক্ষাজগতের সাথে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত বসিরহাটের ছবি সাহা জানান,” শিক্ষা ক্ষেত্রে আমার জীবন ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কিছু জিনিস শিখিয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হল কঠিন পরিস্থিতির মোকাবিলা। দুটো কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার পর আমি আরো লড়াকু হই আর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তের তাৎপর্য উপলব্ধি করি। ১৯৯৬ সালে ডঃ দিলীপ কুমার পাহাড়ির তত্বাবধানে আমার প্রথম কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়। আমি ওনার প্রথম দিকের ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার ক্ষেত্রে রোগী ছিলাম। ২০১৪ সালে মেডিকায় আমার দ্বিতীয় কিডনির ট্রান্সপ্লান্ট হয়। আমি ডঃ পাহাড়ি এবং তার টিমের কাছে খুব কৃতজ্ঞ এবং বিশেষ করে মেডিকা পরিবারের কাছে, তাদের অবদানের জন্য, বিশেষ করে যেভাবে আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। নিয়মিত চেক আপের মধ্যে থেকে আর সংযত জীবনযাপন করে আজ আমি ভালো আছি আর জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত উপভোগ করছি। এখন আমি সত্যি খুব কৃতজ্ঞ জীবনের কাছে।”
আরেকজন যিনি পেয়েছেন, প্রবাল কুমার। ৬৪ বছর বয়সী অবসরপ্রাপ্ত সরকারি অফিসার, বর্তমানে নিউটাউন বাসী জানান,” ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে আমার কিডনি ফেলার দিকটি নজরে আসে। ডঃ পাহাড়ির তত্বাবধানে আমার একটি সফল ট্রান্সপ্লান্ট অস্ত্রোপচার হয়। বর্তমানে আমি চার মাস অন্তর চেক আপ করাই। এখন আমি স্বাভাবিক জীবনযাপন করি। আমি যখন কিডনি ফেলার বিষয়টি জেনেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল যে পৃথিবী শেষ হয়ে গেল আমার। যেভাবে ডঃ পাহাড়ি এবং তার টিম আমার কাউন্সেলিং করেন, তাতে আমি আমার ভয় জয় করি এবং চ্যালেঞ্জকে সামনের লড়াই করার সাহস আনি নিজের মধ্যে। এর ফলে আমি ট্রান্সপ্লান্ট পদ্ধতির মধ্যে এগিয়ে পারি এবং এখনও পর্যন্ত আমি স্বাভাবিক জীবন পালন করে রয়েছি।
লেক গার্ডেন নিবাসী ৭৪ বছর বয়সী সরলা লাখটিয়া নিজের জীবন নিয়ে বলতে গিয়ে বলেন,” ২০০৭ সালে, আমার কিডনি ফেল করার বিষয়টি ধরা পড়ে। এই দুঃখের খবরটি জেনে আমি ডঃ পাহাড়ির মতামত নিই। উনি আমায় জানান যে ভেঙে পড়ার কিছু নেই। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার সুযোগ রয়েছে। সেই হলে আমি সুস্থ হয়ে যাব এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারব। আমার সেই বছরই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হয়। সেই সময় থেকেই আমি চার মাস অন্তর অন্তর ডঃ পাহাড়ির তত্বাবধানে চেক আপে রয়েছি। আমি এবং আমার পরিবার ওনার কাছে খুবই কৃতজ্ঞ আমাকে নতুন জীবন দেওয়ার জন্য। কিডনি বিকল হওয়ার মত মারাত্মক সমস্যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ওনার সাহায্য কখনো ভুলে যাওয়ার নয়।
(প্রফেসর) ডঃ দিলীপ কুমার পাহাড়ি জানান,” কিডনি ফেল হওয়ার ঘটনায়, আমরা এমন একটি পরিস্থিতির মুখোমুখি হই, যখন কিডনির ক্ষমতা হ্রাস পাওয়ার দিকটি আটকানো মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠে। এই সময়ের দুই ধরনের রাস্তা বা পদ্ধতি নিয়ে এগিয়ে চলার সুযোগ থাকে, ডায়ালিসিস বা কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট। ডায়ালিসিস অনেকের ক্ষেত্রেই খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকলেও, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অনেক ভালো জীবন দিতে পারে এবং অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য। কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট সফল হলে মানুষের আয়ু বৃদ্ধি হতে পারে এবং কিডনির অসুখের আগের পরিস্থিতির দিকে এগোতে পারি। পুরো পরিস্থিতির সম্ভাবনা না কমলেও, কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট অনেক সমস্যা দূরে করতে পারে। তবে জেনে রাখা দরকার যে এই অস্ত্রোপচারের সাথে কিছু ঝুঁকি রয়েছে এবং জীবন ব্যাপী ওষুধ খাওয়ার দিকটি আছে।
যেহেতু কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট করার দিকটি নিয়ে অনেক চাহিদা রয়েছে, তাই সাধারণ মানুষের উচিত মৃত্যুর পর অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দানের বিষয়ে আরো এগিয়ে আসা। একজনের অঙ্গ আরেকজনকে দিয়ে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতে পারে। তাই মানুষের মধ্যে এই নিয়ে সচেতনতা জরুরি।”
এই কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট চ্যাম্পিয়ন্স মিট চলাকালীন একটি বিশেষ কেস বাকিদের থেকে অনেকটাই সামনে এসেছিল যেটির কথা ডঃ রোহিত রুংতা বলেন। ৩৫ বছর বয়সী মিজোরামের আইজলের লালিয়ানপুইয়ের আগে থেকেই জটিল মেডিক্যাল ইতিহাস ছিল কিডনির সমস্যা নিয়ে। ২০১২ সালে তার কিডনির অস্ত্রোপচার হয়, পরবর্তীকালে আবার হয় ২০২০ সালে। যখন তিনি অন্তসত্ত্বা হয়ে পড়েন, দেরি না করে যোগাযোগ করেন ডঃ রোহিত রুংতার সাথে। তিনি জানতেন যে কিডনি সংক্রান্ত কারণে এই বিষয়ে জটিলতা তৈরি হতে পারে। ডঃ রুংতা এক কেস রেফার করেন ডঃ শিল্পীতা ব্যানার্জির কাছে, যিনি কনসালটেন্ট, অবেশট্রিক্স এবং গাইনিকলজি বিভাগের সাথে যুক্ত রয়েছেন স্পেশালাইজড কেয়ার নিয়ে।
এই কেসটির ব্যাপারে কথা বলতে গিয়ে ডঃ শিল্পীতা ব্যানার্জি বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন যেখানে উঠে আসে,”এত রিস্ক নিয়ে কোন প্রেগনেন্সির ক্ষেত্রে, যেখানে রোগী অন্য রাজ্য থেকে এসেছেন, সেখানে ভীষণ ভালো যোগাযোগ ও বোঝাপড়ার প্রয়োজন এবং স্পেশালাইজড কেয়ার নেওয়ার খুব দরকার। এছাড়া ডঃ রোহিতের সাহায্যে ইমিউনো সপ্রেসেন্ট নাগালের মধ্যে রাখা, যাতে ওষুধ কোন ভাবেই নতুন কিডনির উপর প্রভাব না ফেলে এবং তার ফিটাল গ্রোথ যেন ঠিক হয়, যাতে ইন্ত্রাইউটেরাইন গ্রোথ রেস্ট্রিকশন (আইইউজিআর) এবং কঞ্জেনাইটাল সমস্যা এড়ানো যায়। এই কারণে প্রতিটি ধাপ খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। ৩৪ সপ্তাহের চেক আপে আমরা দেখি ডপলার লেভেলে কিছু সমস্যা দেখা দিচ্ছে। তাই সেই সময় পরামর্শ ছিল শিশুটির ডেলিভারি করে নেওয়া যত দ্রুত সম্ভব, যাতে কোন জটিলতা তৈরি না হয়।গাইনিকলোজি হোক কিংবা নেফ্রোলজি, আমরা বিভিন্ন বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে এগিয়েছি যাতে মা এবং শিশু, উভয়েই ভালো থাকে, সুস্থ থাকে। আমাদের টিমের কর্মপ্রচেষ্টা আর রোগী আমাদের কথা মেনে চলার ফলে, সাফল্যের সাথে ডেলিভারি হয় এবং মা ও শিশুর শরীর সুস্থ থাকে। বলাই বাহুল্য, কোলাবরেটিভ কেয়ার এবং প্রোঅ্যাক্টিভ ম্যানেজমেন্টের উৎকৃষ্ট উদাহরণ হিসেবে থাকবে এই জটিল অথচ সফল একটি জার্নি।”
এই ক্রিটিকাল ডেলিভারি নিয়ে বলতে গিয়ে ডঃ রোহিত রুংতা বক্তব্য রাখেন,” লালিয়ানপুই ২০১২ সাল থেকেই আমার তত্বাবধানে ছিল। যখন শুনলাম ও অন্ত্বসত্তা আর ওর মনোবল দেখে আমার খুব ভালো লাগল। আমি ডঃ শিল্পীতা ব্যানার্জির কাছে যেতে বললাম। আর নিজে শুধু যোগাযোগ রাখলাম নয়, তার সাথে খোঁজ খবর রাখলাম কারণ ওর ইমিউনো সপ্রেসেন্ট যেন সঠিক প্রক্রিয়ায় থাকে আর কোন জটিলতা তৈরি না হয়। তিনি নিয়মিত চেক আপে থাকার জন্য এবং সবসময় যোগাযোগ রাখার কারণে তার পুরো জার্নি ভালো ভাবে এগিয়েছে। বছরের শুরুর দিকে ওনাকে আর ওনার সদ্যোজাত শিশুকে দেখে খুব ভালোলেগেছে।”
মিজোরামের আইজলের বছর পঁয়ত্রিশের লালিয়ানপুই বলেন,”আমি ভীষণ ভাবে কৃতজ্ঞ মেডিকার কাছে আমার অন্তসত্ত্বা অবস্থায় সম্পূর্ণ দেখভালের জন্য। আমার কিডনির সমস্যা তথা জটিলতার কথা মাথায় রেখে পুরো বিষয়টি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে খেয়াল রেখে দেখা হয়েছে, বিশেষ করে ডঃ রোহিত রুংতার তত্ত্বাবধানে, আমার অন্তসত্ত্বা অবস্থায় পর্যাপ্ত ভাবে দেখা হয়েছে সমস্ত পরিস্থিতি মাথায় রেখে। ডঃ শিল্পীতা ব্যানার্জি পুরোদস্তুর প্ল্যান ও সাহায্য করেছিলেন ডেলিভারির সময়, যা আমার আস্থা অর্জন করে। কাউন্সেলিং সেশনের দরুন আমার ইমোশনাল শক্তি থেকেছে আর আমার পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে তারা ডেলিভারির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, যা সত্যি অনবদ্য। মেডিকাকে অনেক ধন্যবাদ, তাদের জন্য আমি আজ মা হতে পেরেছি।”
অয়নাভ দেবগুপ্ত, জয়েন্ট ম্যানেজিং ডিরেক্টর, মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, বলেন,”এই ধরনের জীবনযুদ্ধে জয়ীদের কথা শুনে বারবার এটাই মনে হয় যে ট্রান্সপ্লান্ট হওয়ার পরবর্তী সময়ে আনন্দময়, ফলপ্রসূ ও কার্যকরী জীবন কাটানো সম্ভব। আমি সেই সমস্ত পরিবারগুলোকেও ধন্যবাদ জানাতে চাই যারা কিডনির রোগে ভুগতে থাকা মানুষগুলোর পাশে থাকেন। তারা সাহায্য করেন, পাশে থাকেন এবং হৃদয় থেকে ভালোবাসেন। তাদের উদ্যম ও শক্তির সাথে আমাদের ডাক্তারদের স্কিল যে কোন চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারে এবং রোগীদের নতুন করে বাঁচার আশা তৈরি করে।”
মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল সম্পর্কে: মেডিকা গ্রুপ অফ হসপিটাল, পূর্ব ভারতের অন্যতম প্রধান হসপিটাল চেন, শেষ কয়েক বছরে পূর্ব ভারতে জুড়ে একাধিক স্বাস্থ্য পরিষেবা কেন্দ্র তৈরি করেছে। বর্তমানে এই গ্রুপের উপস্থিতি রয়েছে পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, ওডিশা, বিহার এবং আসামে।
Be First to Comment