জন্মদিনে স্মরণঃ অ নি ল চ ট্টো পা ধ্যা য়
বাবলু ভট্টাচার্য : আপাত দৃষ্টিতে দেখলে মনে হবে তিনি খুব সাধারণ একজন অভিনেতা। কিন্তু যখন সত্যজিৎ রায়ের ‘মহানগর’ দেখি তখন বিস্ময়ের ঘোর কাটে না। মধ্যবিত্ত ছাপোষা ঘরকুনো একজন স্বামীর চরিত্রে অনিল চট্টোপাধ্যায় যে স্বাভাবিক সহজাত অভিনয় করেছেন, তা এককথায় অনবদ্য।
এরপর ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ ছবিতে, অসুস্থ বোন তার চিকিৎসার প্রয়োজন, দাদার উপর ভার পড়েছে বোনকে দার্জিলিংয়ের হাসপাতালে পৌঁছে দেবার কারণ তার বোনের টিবি হয়েছে। বোনের প্রতি গভীর ভালোবাসা অথচ তার অন্তহীন দুঃখের ছবি অনিল চট্টোপাধ্যায় যেভাবে প্রকাশ করেছিলেন অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাকে উঁচু মাপের অভিনয় ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না।
মৃণাল সেনের ‘একদিন আচানক’ হিন্দি ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায় বুঝিয়ে দিয়েছিলেন তিনি কোন স্তরের অভিনেতা।
তপন সিংহের ‘জতুগৃহ’ ছবিতে পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এই ছবিতে তিনি যেন বসন্তের হাওয়া, উত্তম কুমার-অরুন্ধতী দেবীর মনোমালিন্য ডিভোর্সের প্রেক্ষাপটে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের খোলামেলা অভিনয় যেন ছবিতে টাটকা বাতাস নিয়ে এসেছিল।
সত্যজিৎ রায় ‘দেবী’ ছবিতে একটি ছোট চরিত্র দিয়েছিলেন অনিল চট্টোপাধ্যায়কে, কিন্তু সেই ছোট চরিত্রের মধ্যে অনিল যে ব্যাপ্তি এনেছিলেন তাঁর প্রতিভার মাধ্যমে তা সত্যিই অবাক করার মত।
তপন সিংহ আরেকটি সিনেমা ‘সাগিনা মাহাতো’, এই ছবিতে সম্পূর্ণ ভিন্ন অনিলকে আমরা দেখলাম, একটি ভয়ঙ্কর নেগেটিভ চরিত্রে অনিল সবাইকে অবাক করে দিলেন।
সুচিত্রা সেন অভিনীত ‘সন্ধ্যাদীপের শিখা’ ছবিতে অনিল সুচিত্রার এক বন্ধুর চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। তিনি ছিলেন এক অবাঙালি বন্ধু, হিন্দি উচ্চারণে তিনি যে কতখানি সাবলীল তা প্রমাণ করেছিলেন এই প্রতিভাবান অভিনেতা।
ঋত্বিক ঘটকের ‘নাগরিক’, ‘কোমল গান্ধার’, ‘অযান্ত্রিক’। সত্যজিৎ রায়ের ‘তিন কন্যা’-র অন্তর্গত ‘পোস্টমাস্টার’, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’। অসিত সেন এর ‘স্বরলিপি’। অগ্রদূতের ‘অগ্নি সংস্কার’। অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়ের ‘আহ্বান’। যাত্রিকের ‘কাঁচের স্বর্গ’। পিনাকি মুখার্জীর ‘রক্ত পলাশ’ প্রভৃতি ছবিতে অনিল নিজের মহিমা বিকাশ করেছেন।
তপন সিংহের ছবি ‘নির্জন সৈকতে’, তাঁর অভিনয়ের মুকুটে একটি উজ্জ্বল পালক। ১৯৬৪ সালে, ‘কে তুমি?’ নামে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল, ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায় যে ধরনের সফিস্টিকেটেড অথচ গম্ভীর অভিনয় করেছিলেন, তা ক’জন মনে রেখেছে সন্দেহ আছে?
অথচ এই ছবির গল্প নিয়ে পরে যখন হিন্দি সিনেমা ‘কটি পতঙ্গ’ হয়েছিল সেই ছবিটি কিন্তু কেউ ভোলেননি। অনিল চট্টোপাধ্যায় এই সিনেমায় একটি অন্য ধরনের রং-তুলি ব্যবহার করেছিলেন তাঁর অভিনয়ে। ছবিটি অনিল বাবুর অভিনয়ে ধন্য।
উৎপলেন্দু চক্রবর্তী ‘চোখ’ ছবিতে একজন ডাক্তারের চরিত্রে অভিনয় করিয়েছিলেন অনিল বাবুকে দিয়ে। সেখানেও তিনি পরিণত বয়সে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছিলেন।
অনিল চট্টোপাধ্যায় সন্ধ্যা রায়ের সঙ্গে ‘নতুন জীবন’, ‘জীবন সঙ্গীত’, ‘হাই হিল’। সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় এর সঙ্গে ‘মুক্তি স্নান’, ‘বালুচরী’। মাধবী মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘সিঁদুরে মেঘ’, ‘সমান্তরাল’, ‘দেবতার দীপ’।
অভিনেত্রী জ্যোৎস্না বিশ্বাস এর সঙ্গে ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’। অঞ্জনা ভৌমিক এর সঙ্গে ‘মহাশ্বেতা’। রুমা গুহ ঠাকুরতা সঙ্গে ‘পঞ্চশর’ প্রভৃতি ছবিতে রোমান্টিকতার প্রকাশ ঘটিয়ে ছিলেন।
৭০ এর দশকে ‘দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন’ সিনেমায় নাম ভূমিকায় অভিনয় করে বিশেষ প্রশংসিত হয়েছিলেন। উত্তমকুমারের প্রয়াণের পর ‘শিল্পী সংসদ’-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন দীর্ঘদিন।
১৯৯৬ সালের ১৭ মার্চ অনিল চ্যাটার্জি মৃত্যুবরণ করেন।
অনিল চট্টোপাধ্যায় ১৯২৯ সালের আজকের দিনে (২৫ অক্টোবর) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment