শতবর্ষের শ্রদ্ধাঞ্জলি : মৃ ণা ল সে ন
“মৃণাল’দা কিন্তু কখনোই দ্বিতীয় সত্যজিৎ ছিলেন না। তিনি ছিলেন তাঁর মতো করেই অনন্য!”
[ পরিচালক শ্যাম বেনেগাল ]
বাবলু ভট্টাচার্য : বাংলা চলচ্চিত্রকে তিনি নিয়ে গেছেন বিশ্ব কাতারে, অথচ মনে প্রাণে তিনি ছিলেন বাঙালি। তাঁর চলচ্চিত্র কথা বলতো গণমানুষের। শোষিত মানুষ, দুর্ভিক্ষ, অভাব, সংগ্রাম, জীবনের বাস্তবতার চরম উপলব্ধির। যিনি ভেঙে দিয়েছিলেন চলচ্চিত্র নির্মাণের সব ব্যাকরণ। তাঁর চলচ্চিত্র হয়ে উঠল চিরন্তন সমাজের অনবদ্য ভাষ্য। তাই তো মৃণাল সেন নামটা উচ্চারণ করলে চোখের সামনে ভাসে আজন্ম অপ্রতিরোধ্য এক চলচ্চিত্র স্রষ্টার কথা।
তাঁর প্রতিটি ছবিতে ক্ষুদ্র গলি থেকে রাজপথ, বস্তি থেকে অট্টালিকার চিত্র তিনি তুলে ধরেছেন, যা পেয়েছে বৈশ্বিক রূপ। আর এখানেই তিনি অনন্য, সবার থেকে আলাদা। তিনি সমাজ বাস্তবতাকে সবসময় গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর ছবিতে নকশাল আন্দোলন যেমন এসেছে, তেমনি এসেছে শ্রেণি দ্বন্দ্ব, এসেছে দরিদ্র আদিবাসীদের কথাও।
সত্যজিৎ রায় যখন ঊনিশ শতকীয় মানবিকতাবাদকে চলচ্চিত্রীয় বাস্তবে রূপান্তরিত করার চেষ্টায় রত বা ঋত্বিক ঘটক যখন ইতিহাসের উপাদানগুলিকে পৌরাণিক লোককথার সঙ্গে জুড়ে এক ধরনের বিস্ফোরক বাস্তবতা তৈরি করছেন, তখন মৃণাল সেন নিজের সিনেমার বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন মধ্যবিত্ত ও নাগরিকতার পৃথিবীকে। উপহার দিয়েছেন ‘ভুবন সোম’, ‘খারিজ’, ‘খন্ডহর’, ‘কলকাতা ৭১’, ‘চালচিত্র’, ‘আকালের সন্ধানে’- এর মতো সিনেমা।
র্যাডিক্যাল, মার্ক্সবাদী, কখনো বিদ্রোহী বহু অভিধায় অনেকে তাঁকে ব্যাখ্যা করতে চেয়েছেন। কিন্তু মানুষ হিসেবে অন্য সংজ্ঞার মানুষ ছিলেন বোধ হয় মৃণাল সেন। ভালবাসতেন গোপাল ভাঁড়ের গল্প পড়তে। পুত্র এবং নিজের বন্ধুদের সঙ্গে ছিল তাঁর মজার সম্পর্ক। শোনা যায়, নিজে থেকে বানিয়ে বানিয়ে হাসির গল্প বলতেন মৃণাল সেন। আর সেসব গল্প গোপাল ভাঁড়ের বলে চালিয়ে দিতেন।
নিজের জীবন নিয়ে খুব অনায়াসে বলেছেন, ‘’থামা নেই। ঘড়ির কাটার মতো জীবন। আর প্রতি মুহূর্তে বিজ্ঞান প্রযুক্তি ও মননের প্রথাসিদ্ধ নিয়ম ভেঙে বে-নিয়মের খেলায় মেতে থেকেছি। যা করেছি, যা করে চলেছি, ঠিক বা বেঠিক, পরোয়া করিনি কখনো। ভাবনা কীসের!’’
মৃণাল সেন তাঁর প্রতিটি ছবিতে এক্সপেরিমেন্ট করেছেন। খুঁজেছেন বিষয়-ভাবনা। এখানেই মৃণাল ছিলেন সকলের চাইতে ভিন্ন। ফিল্ম নিয়ে তাঁর পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছিল একজন বৈজ্ঞানিকের মতো। একজন বিজ্ঞানীর যেমন গবেষণার অস্ত্র মাইক্রোস্কোপ, ঠিক তেমনই মৃণালের মাইক্রোস্কোপ ছিল তাঁর ক্যামেরা, তাঁর চিত্রনাট্য।
ছিলেন পদার্থবিদ্যার ছাত্র। লেখাপড়া করেছেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ। প্রথম জীবনে বাধ্য হয়ে কলকাতার বাইরে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের কাজ করেছেন। তবে সে জীবন তাঁর দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আবার তিনি ফিরে আসেন কলকাতায়। কাজ নেন চলচ্চিত্র স্টুডিওতে একজন অডিও প্রযুক্তিবিদ হিসেবে। এখান থেকেই শুরু তাঁর পথচলা। একজন মৃণাল সেন হয়ে ওঠার সূচনা।
‘ভুবন সোম’, ‘কোরাস’, ‘মৃগয়া’ ও ‘আকালের সন্ধানে’-সহ ১৬টি ছবির জন্য মৃণাল সেন জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন।
বাংলাদেশের ফরিদপুরে তাঁর জন্ম। বাল্য- কৈশোর কেটেছে এখানেই। ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র মৃণাল সেন ১৯৪০ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলা ছেড়ে চলে যান ঘটনাবহুল কলকাতায়।
তিনি দেখেছিলেন দাঙ্গার আগুন। দেখেছিলেন দুর্ভিক্ষ আর দেশভাগ। এসব অভিজ্ঞতাই তাঁর ভেতরে তৈরি করেছিল একজন প্রতিবাদী মানুষকে। যোগ দিয়েছিলেন ভারতীয় গণনাট্য সংঘ বা আইপিটিএ-তে। সহকর্মী হিসেবে ছিলেন সলিল চৌধুরী, তাপস সেন, কলিম শরাফী এবং অবশ্যই ঋত্বিক কুমার ঘটক। পরে কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত ছিলেন এই পরিচালক।
‘নীল আকাশের নিচে’ ছবির আগে তৈরি করেছিলেন ‘রাতভোর’। মহানায়ক উত্তমকুমার কাজ করেছিলেন শেষের ছবিটিতে। কিন্তু তখনও মৃণাল সেন সিনেমায় নিজস্ব পথ খুঁজে পাননি। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য ছবি ‘বাইশে শ্রাবণ’। ১৯৬০ সালে নির্মিত এই ছবিতে বড় অংশ হয়ে রয়েছে দুর্ভিক্ষ। বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষের কাহিনি পরবর্তী সময়ে তাঁর ‘কলকাতা-৭১’ ও ‘আকালের সন্ধানে’-তে বড় আকারে ধরা পড়েছে।
কিন্তু মৃণাল সেনকে স্বতন্ত্র ধারায় চিহ্নিত করলো তাঁর ‘ভুবন সোম’। খুব অল্প ব্যয়ে নির্মিত এই সিনেমাটি তরঙ্গ তুলেছিল। একজন কড়া আমলা হিসেবে উৎপল দত্তের অনন্য অভিনয় ও এক সরল গ্রাম্য তরুণী হিসেবে সুহাসিনী মুলের সাবলীল পর্দায় উপস্থিতি ছবিটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছিল।
নকশাল আন্দোলনের অস্থির সময়ে মৃণাল সেন নির্মাণ করেছিলেন তাঁর কলকাতা ট্রিলজি ‘ইন্টারভিউ’, ‘কলকাতা ৭১’ এবং ‘পদাতিক’। এই তিনটি সিনেমায় তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের সেই উত্তাল সময়কে তুলে ধরেছিলেন।
তাঁর সর্বশেষ ছবি, ‘আমার ভুবন’ তৈরি করেন ২০০২ সালে।
‘পদ্মভূষণ’ সম্মানে সম্মানিত হয়েছিলেন তিনি। ২০০৫ সালে ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মানেও ভূষিত করা হয় তাঁকে। তিনি পেয়েছেন দেশ-বিদেশের বহু স্বীকৃতি ও পুরস্কার।
১৯৯৮-২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতীয় পার্লামেন্টের সম্মানীয় সদস্য ছিলেন। ফরাসি সরকার তাঁকে কম্যান্ডুর ডি ল অর্ডারে দেস আর্টস এট লেটার্স (কমান্ডার অফ দ্য অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস)-এর সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করেছিল।
এই মহান চলচ্চিত্র নির্মাতা ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
মৃণাল সেন ১৯২৩ সালের আজকের দিনে (১৪ মে) বাংলাদেশের ফরিদপুরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment