——-জন্মদিনে স্মরণঃ কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স——-
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ‘দুনিয়ার মজদুর এক হও’ শ্লোগানে যিনি শোষিত-বঞ্চিত মেহনতি মানুষকে তাদের ন্যায্য অধিকারের বিষয়ে সচেতন করতে আমৃত্যু সংগ্রাম করেছেন, তিনি হলেন উনবিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত জার্মান চিন্তাবিদ, দার্শনিক, সমাজবিজ্ঞানী ও বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা কার্ল মার্ক্স। তার পুরো নাম কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স (Karl Heinrich Marx)। তার বাবা হার্শেল মার্ক্স পেশায় আইনজীবী ছিলেন। তাদের পূর্বপুরুষ যদিও ইহুদি ধর্মাবলম্বী ছিলেন, কিন্তু মার্ক্স জন্মাবার পরে তার পরিবার খ্রিষ্টান (প্রটেস্টান্ট) ধর্মে দীক্ষিত হয়। ছোটবেলা থেকে মার্ক্স ভালো ছাত্র হিসাবে পরিচিত ছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন একজন স্বভাব কবি। তিনি বন ও বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন, দর্শন এবং ইতিহাসের পাঠ গ্রহণ করেন এবং ১৮৪১ সালে তিনি ইউনিভারসিটি অফ জেনা থেকে পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন।
শিক্ষাজীবন শেষে তিনি রাইনল্যান্ডের যুবকদের দ্বারা পরিচালিত ‘রাইন অঞ্চলের সংবাদ পত্র’ নামক পত্রিকায় যোগ দেন এবং ১৮৪২ সালে তার সম্পাদক নিযুক্ত হন। সম্পাদক হিসাবে যোগ দেয়ার পর থেকেই ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে কাগজটির প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়লে তৎকালীন সরকার পত্রিকাটি বন্ধ করে দেয়। এই সময় মার্ক্স অর্থশাস্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট হন এবং তার পাঠ নেয়া শুরু করেন। ১৮৪৩ সাল মার্ক্সে তার প্রেমিকা জেনি ভন ভেস্তফানেলকে বিয়ে করেন। এরপর তিনি প্যারিসে চলে আসেন এবং এখান থেকেই তিনি শুরু করেন অপরিসীম দারিদ্র ও ইউরোপীয় শক্তিশালী রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে লড়াই। আর মার্ক্সের এই সংগ্রামে তার পরিবারের পাশে এসে দাঁড়ান তার অকৃত্রিম বন্ধু ও সহযোগী ফ্রেডরিক এঙ্গেলস। ১৮৪৫ সালে প্রাশিয়ার সরকারের ষড়যন্ত্রে তিনি প্যারিস থেকে পরিবার সমেত বিতাড়িত হন এবং তিনি চলে যেতে বাধ্য হন ব্রাসেলস-এ। ১৮৪৭ সালে মার্ক্স ও এঙ্গেলস কম্যুনিস্ট লিগে যোগ দেন এবং সেই বছরই এঙ্গেলস-এর সহযোগিতায় যৌথভাবে রচনা করেন শ্রমিক শ্রেণীর অমোঘ হাতিয়ার ‘The Communist Manifesto’। মার্ক্স সমাজতন্ত্রের যে আদর্শ প্রচার করেছেন রাষ্ট্র দর্শনের আদর্শ হিসাবে তা একেবারেই নতুন নয়। আদর্শ হিসাবে সমাজতন্ত্রের জন্ম সুপ্রাচীন কালে গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর লেখনীতে হলেও উনবিংশ শতাব্দীতে সমাজতন্ত্রের যথার্থ আত্মপ্রকাশ ঘটে রবার্ট ওয়েন, সেন্ট সাইমন, চার্লস ফুরিয়ারের লেখনীর মাধ্যমে। তবে এদের মতবাদ পরিপূর্ণতা ও বাস্তবতা বর্জিত হওয়াই তা কাল্পনিক সমাজতন্ত্র হিসাবে আখ্যায়িত হয়। সমাজতন্ত্রকে কল্পনার রাজ্য থেকে ইতিহাস ও অর্থনীতির বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের উপর প্রতিষ্ঠিত করেন মার্ক্স ও এঙ্গেলস। তারা সমাজতন্ত্রকে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের বৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করেন এবং এটিকে চিন্তার মানসলোক থেকে টেনে বের করে মানুষের বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেন।রাষ্ট্র সম্পর্কে মার্ক্সের ধারণা সনাতনী ধারণার সম্পূর্ণ বিপরীত ও চিত্তাকর্ষক। ‘রাষ্ট্র একটি সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান এবং তা মানুষের জীবনে মঙ্গল ও কল্যাণ বয়ে আনে’- এমন সনাতনী ধারণার তিনি তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, রাষ্ট্র অভিন্ন কল্যাণের লক্ষ্যে নিবেদিত কোন সার্বজনীন প্রতিষ্ঠান নয় বরং তা যে কোন সমাজের প্রভাবশালী অর্থনৈতিক শ্রেণীর হাতে গড়া একটি সংগঠন এবং অন্যান্য শ্রেণীর উপর এই শ্রেণীর শাসন ও শোষণকে মজবুত করাই এর প্রধান লক্ষ্য। এটি প্রভাবশালী বুর্জোয়া শ্রেণীর একটি নির্বাহী কমিটি ছাড়া আর কিছুই নয়।
মার্ক্স তার নিজস্ব সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারার আলোকে পুঁজিবাদী সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার মৌলিক কিছু ত্রুটির কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে ‘উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব’ নামে তিনি একটি মৌলিক তত্ত্বের আবিষ্কার করেন। তিনি অন্যান্য পণ্যের ন্যায় মানুষের শ্রম শক্তিকে একটি পণ্য বলে বিবেচনা করে বলেছেন যে, অন্যান্য পণ্যের মত শ্রমেরও দ্বিবিধ মূল্য বিদ্যমান যা বিনিময় মূল্য এবং ব্যবহারিক মূল্য বলে অবিহিত করা যায়। শ্রম সংগ্রহ করার জন্য শ্রমিককে যে মূল্য দেওয়া হয় তা বিনিময় মূল্য। কিন্তু শ্রমিকের শ্রমের ফলে সৃষ্ট দ্রব্যাদি বাজারজাত করে যে মূল্য পুঁজিপতিরা অর্জন করে তা হলো শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য। মার্ক্স এখানে দেখান যে, শ্রমের বিনিময় মূল্য অর্থাৎ শ্রমিককে প্রদত্ত পারিশ্রমিকের চেয়ে শ্রমের ব্যবহারিক মূল্য সব সময় বেশী থাকে। ব্যবহারিক মূল্যের এই উদ্বৃত্ত অংশকে তিনি ‘উদ্বৃত্ত মূল্য’ বলে অভিয়িত করেছেন। তিনি এই উদ্বৃত্ত মূল্যকে পুঁজিপতিদের ‘চৌর্যবৃত্তির মাধ্যমে অর্জিত মূল্য’ বলে গণ্য করেছেন। মার্ক্সের তত্ত্ব অনুসারে, মানব সমাজের প্রতিটি রাজনৈতিক অবস্থা তার বিশেষ বিশেষ অর্থনৈতিক উৎপাদন ব্যবস্থার ফলশ্রুতি। অর্থাৎ, অর্থনৈতিক উৎপাদনের মাধ্যমগুলো যখন যে শ্রেণীর হাতে সংরক্ষিত থাকে তখন সেই শ্রেণী সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রাধান্য লাভ করে এবং তদানুসারে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীবন ব্যবস্থার গতি প্রকৃতি নির্ধারিত হয়। এই উৎপাদন ব্যবস্থায় মানব সমাজ পুঁজিপতি ও প্রলিতারিয়েট-এই দুই শ্রেণীতে বিভক্ত হয় এবং এদের মধ্যে সংঘর্ষ দেখা দেয়।
কার্ল হাইনরিশ মার্ক্স ১৮১৮ সালের আজকের দিনে (৫ মে) তৎকালীন প্রাশিয়ার ত্রিভস শহরে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment