দুই বিপরীত মানসিক অবস্থার নাগরদোলায় বাইপোলার ডিজ অর্ডার।
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ২৮মে, ২০২০। তুচ্ছ বিষয়ে বিরাট আনন্দ হয়, আত্মবিশ্বাস একলাফে কয়েকগুন বেড়ে যায়। আবার কয়েক দিন বাদে একদমই বদলে যায়, মন- আত্মবিশ্বাসে ভাঁটা পড়ে। অন্যদের তুলনায় নিজেকে বিন্দু বলে মনে হয়। পুরানো ভুলের যন্ত্রনা শেষ করে দেয়। কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না, কোনও কাজে মন বসে না। এই পরিস্থিতি যেকোন মানুষের জীবন কে তছনছ করে দিতে পারে যেকোনো সময়ে। এই ভাবে দুই বিপরীত মানসিক অবস্থার ক্রমাবর্তন কে বাইপোলার ডিজ অর্ডার বলে।
মানসিক স্বাস্থ্যের এক কঠিন সমস্যা। বাই অর্থাৎ দুই, পোল হলো প্রান্ত। এ অসুখের এক প্রান্তে থাকে ডিপ্রেশন বা বিষন্নতা, অন্য প্রান্তে থাকে ম্যানিয়া। আক্রান্ত মানুষটির ভিতরে পরমানন্দ বোধ, ও চরম বিষন্নতা এই দুই মানসিক অবস্থার অস্বাভাবিক ক্রম আবর্ত হয়। বয়ঃসন্ধিকালে শুরু হওয়া এই সমস্যার শনাক্ত করন এ দেরী হয়ে যাওয়ার জন্য সমস্যাটি তীব্র অবস্থা বা ম্যনিক স্টেজে পৌঁছে যায়। তবে প্রাথমিক অবস্থায় নির্ধারিত হলে বাইপোলার ডিজ অর্ডার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। আক্রান্ত ব্যক্তির যে দুরকম আচরণগত বৈশিষ্ট্য থাকে, তার একটি হলো “ডিপ্রেশন”।
অনেক দিন ধরে মনখারাপ, কাজে ইচ্ছা বা আগ্ৰহ না থাকা, বিমর্ষতা, আনন্দের অনুভূতি কমে যাওয়া, ঘুম কমে যাওয়া, আত্মবিশ্বাস না থাকা,কোনও কাজের জন্য অনুতপ্ত বোধ, ভালো বাসা বা যৌনতার অনুভূতি কমে যাওয়া, ভবিষ্যত অন্ধকার মনে হওয়া, খাওয়ার ইচ্ছা কমে যাওয়ার মতো উপসর্গ দেখা যায়। দুসপ্তাহ বা তার বেশী দিন ধরে থাকা এই অবস্থা কে ডিপ্রেসিভ ডিজ অর্ডার বলে। বাইপোলার ডিজ অর্ডার এর দ্বিতীয় প্রান্তের নাম ম্যানিয়া। যে উপসর্গ গুলি ডিপ্রেশন এ থাকে, তার ই বিপরীত অবস্থান ম্যানিয়া। আক্রান্ত ব্যক্তি আস্বাভাবিক আনন্দ অনুভব করে, অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে পড়ে, দ্রুত এবং মাত্রাতিরিক্ত কথা বলে, কাজের স্পৃহা বেড়ে যায়। চিন্তার গতি বেড়ে যায় এবং একটা চিন্তা শেষ হতে না হতেই আর এক চিন্তা চলে আসে।
ঘুমের প্রয়োজন বুঝতে পারে না, ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে, যৌন চাহিদা বেড়ে যেতে পারে। অবাস্তব পরিকল্পনা বুঁদ হয়ে থাকে। অনর্থক টাকা পয়সা খরচ করতে থাকে। সঠিক বিচার বোধ কাজ করে না। এই পর্যায়ে কে বলা হয় ম্যানিক স্টেজ বা হাইপোম্যনিয়া। তবে বাইপোলার ডিজ অর্ডার মানে রোগী সর্বক্ষণ ডিপ্রেশন থেকে ম্যানিয়া’র মধ্যে ঘোরা ফেরা করবে। দুটি পর্যায়ের মধ্যে বেশ কিছু দিন সুস্থ স্বাভাবিক থাকে। এই রোগের সুনির্দিষ্ট কারন বলা যায় না। জিন বা বংশগত কারনে এরকম হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে, তার সাথে সামাজিক কারন যোগ হলে যেমন পারিবারিক অবস্থা, নিঃসঙ্গতা, পড়াশোনার আরোপিত চাপ, ইমোশনাল সাপোর্টের অভাব, ইত্যাদি বাইপোলার ডিজ অর্ডার কে অনিয়ন্ত্রিত হতে সাহায্য করে।
বাইপোলার ডিজ অর্ডার এ চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য থাকে মুডের নাগরদোলা কে নিয়ন্ত্রণে রাখা। এই গোত্রের ওষুধ কে বলা মুড স্টেবিলাইজার। তবে ডিপ্রেসিভ উপসর্গ থাকলে এন্টি ডিপ্রেসিভ ড্রাগস দেওয়া হয়। তবে এই প্রকার সমস্যার ক্ষেত্রে পর্যাপ্ত তথ্য ও সচেতনতা অভাবে সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির আচরণ কে শুরু তে মানসিক সমস্যার লক্ষন বলে মনে করেন না তার পরিবারের সদস্য রা। ফলে সমস্যাটি তীব্র অবস্থায় না পৌছালে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয় না। তাই চিকিৎসা শুরু করতে ও দেরী হয়। বাইপোলার ডিজ অর্ডার এ মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। তবে, পরিবার ও পারিপার্শ্বিক অবস্থার সমন্বয়ে চিকিৎসা করলে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে আনা যায়।
যেহেতু এই রোগ পুরোপুরি সারে না, সেহেতু আক্রান্ত ব্যক্তি কে সুস্থ করে তোলার জন্য পরিবারের ও কাছের মানুষদের খুব সতর্ক থাকতে হবে, রোগীর সময়মতো ওষুধ খাচ্ছে কিনা, নিয়মিত ফলোআপ করতে আসছে কিনা, ঘুম, মেজাজ, বা মনের কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তন হচ্ছে কিনা, ইত্যাদি বিষয়ে। বাই পোলার ডিজ অর্ডার বৈশিষ্ট্য নিয়েই প্রচুর মানুষ দৈনন্দিন জীবনে বেঁচে আছে, হয়ত একটু সাহচর্য, ভালোবাসা, নির্ভরতা দেখালে সহজেই স্বাভাবিক হতে পারবে সেই মানুষগুলো।
Be First to Comment