——পর্যটক, পর্যটন, মুনাফা : করোনা পরবর্তী সময়ে কি হবে ভারতের?——
রণবীর ভট্টাচার্য: কলকাতা, ২০মে, ২০২০। ঘুরতে যেতে সব মানুষেরই ভালো লাগে। তবে শুধু বাঙালি নয়, পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তের মানুষই ঘুরতে যেতে ভালবাসেন। তাই পর্যটন স্রেফ আর ছুটি কাটানো নয়, তার চেয়েও অনেক বড়।
পর্যটন শিল্পের উপর ভরসা করেই তাবড় তাবড় দেশের অর্থনীতি নির্ভর করে আছে। এই চেনা ছকের সুবিধা ভারতের মতো দেশও পেয়েছে আর তাই কোষাগারে বিদেশী মুদ্রা আনার ক্ষেত্রে পর্যটন শিল্পের আশীর্বাদ ও থেকেছে দশকের পর দশক।
ঐতিহাসিক স্থান, ধর্মীয় স্থান থেকে আরম্ভ করে মনোরম সমুদ্রতট কিংবা বরফে ঢাকা পাহাড় – কি নেই ভারতে! কিন্তু করোনা এসেই সব হিসেব পালটে দিল।
করোনার গ্রাসে মানুষ আজ বাড়ির ঘেরাটোপে বন্দি, সামাজিক দূরত্ব রাখার তাগিদে বাজার, সেলুনে যাওয়া হয়ে গিয়েছে কঠিন কাজ, রোজ অগুনতি মানুষ চাকরি হারাচ্ছে – ঘুরতে যাওয়া মনে হচ্ছে অনেক দূরের ব্যাপার।
এখনও মানুষ জানে না যে আদৌ টিকা পাওয়া যাবে কিনা না ‘মানিয়ে নিতে হবে’। তাহলে ভারতে বা অন্য দেশগুলোতে পর্যটন শিল্পের কি ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে?
বলাই বাহুল্য, মানুষ ঘুরতে তখনই যায়, যখন তার কাছে পর্যাপ্ত বা একটু বেশিই অর্থের যোগান থাকে। কিন্তু এই কথা তো স্রেফ যারা ঘুরতে যান তাদের অর্থনৈতিক মানসিকতা ভেবে বলা।
এই পর্যটন শিল্পের সাথে জড়িয়ে আছে কোটি কোটি মানুষের জীবন – হোটেল ব্যবসা, গাড়ি ব্যবসা, এয়ারলাইনস, ট্যুর অপারেটর,
বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুরিস্ট গাইড, অনুবাদক – এত মানুষের রুজি রোজগার দাঁড়িয়ে রয়েছে পর্যটন শিল্পের উপর।
যেদিন ভারতে ব্যবসায়িক সাধারণ দেশীয় উড়ান এবং বিদেশী উড়ান বন্ধ হল, সেদিনই সিঁদুরে মেঘ দেখেছিল এই পর্যটন শিল্পে কাজ করা দেশ জুড়ে অসংখ্য মানুষ।
এখন করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়া থেকে অনেক দূরে এবং প্রথম বিশ্বের অনেক দেশ স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছেন যে সামাজিক দূরত্ব রাখার তাগিদে পর্যটন ব্যবসা শুরু করা এক প্রকার অসম্ভব।
হাজার হাজার বুকিং বাতিল করে অনেক ক্ষতির মুখে পড়েছে হোটেল ব্যবসায়ীরা, এয়ারলাইনসগুলো চরম ক্ষতির মুখে – পর্যটন শিল্পে অনেকের তো চাকরি গেছেই এর মধ্যে, অদূর ভবিষ্যতেও সম্ভাবনা খুব কম।
এর মধ্যে অনেকের আশা ছিল যে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন বিশেষ কোন আর্থিক প্যাকেজের কথা ঘোষণা করবেন পর্যটন শিল্পের কথা মাথায় রেখে।
কিন্তু কয়েক দফায় তিনি যেই সমস্ত সরকারি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন তার মধ্যে পর্যটন শিল্পের জন্যে আলাদা করে কিছু দেওয়ার কথা বলা নেই।
অনেকেই বলেন যে সংগঠিত শিল্পের আওতার মধ্যে ভাবা উচিত পর্যটন শিল্পকে। কিন্তু দেখা গিয়েছে, এই শিল্পে চাকরির সুরক্ষা সবচেয়ে কম, অনেকটা কাজ না হলে রোজগার হবে না এইরকম।
ইতিমধ্যেই বলা হচ্ছে যে কোন বিশেষ সাহায্যের কথা ঘোষণা করা না হলে, ভারতের প্রায় ৭০% হোটেল ও রেস্টুরেন্ট বন্ধ হয়ে যাবে।
সব মিলিয়ে ভারতে ৫৩,০০০ হোটেল এবং ৭০ লক্ষ রেস্টুরেন্ট রয়েছে।
অসংগঠিত রেস্টুরেন্টের সংখ্যা প্রায় ২.৩ কোটি ভারতে। ভুলে গেলে চলবে না, ভারতের জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ আসে পর্যটন শিল্প থেকে – অর্থাৎ ভ্রমণ, এয়ারলাইনস এবং হসপিটালিটি ইন্ডাস্ট্রি থেকে।
এই অবস্থায় বিপুল সংখ্যক মানুষের রাতারাতি বেকার হওয়া পরোক্ষ ভাবে দেশীয় অর্থনীতির সঙ্কট ডেকে আনতে পারে।
তবে যে কথা না বললেই নয়, পর্যটন শিল্পের এই দুরবস্থা শুধু ভারতে নয়, সামগ্রিক ভাবে সারা বিশ্বেরই এক অবস্থা।
এই অভূতপূর্ব অবস্থায়, সৌদি আরব এই বছরের হজ যাত্রা স্থগিত রেখেছে আবার খাস রোমে ইস্টারের সময়ে জনসমাগম নিষিদ্ধ ছিল।
পর্যটন শিল্প কেন এতদিনেও স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে পারেনি সেই প্রশ্ন ওঠাও অমূলক নয়।
তবে আশার কথা এটাই যে করোনা পরিস্থিতি চিরকাল থাকার নয়। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন রাজ্যকে ইতিমধ্যেই করোনা পরিস্থিতি সামলানোর জন্যে অর্থ সাহায্য করেছে।
এই অবস্থায় রাজ্য সরকারগুলো যদি প্রত্যক্ষ ভাবে এই শিল্পের পাশে এসে দাঁড়ায়, তাহলে কাজের কাজ হবে।
কেরালা,গোয়া, পশ্চিমবঙ্গ, কাশ্মীর, তামিলনাড়ুর মত অনেক রাজ্য কিন্তু কোষাগারের অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে নির্ভর করে থাকেন পর্যটন শিল্পের উপর।
কঠিন সময়ে সাহায্য কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থের কথা মাথায় রেখে করা যেতেই পারে।
আশার কথা, ইতিমধ্যেই গোয়ার মত রাজ্য জানিয়ে দিয়েছে যে সেখানে কিন্তু মানুষ আবারও পর্যাপ্ত সামাজিক দূরত্ব বিধি মাথায় রেখে ঘুরতে যেতে পারে।
তাই আশা রাখতেই হবে, সামনের দিনগুলো যেন ঘুরে দাঁড়াতে পারে ভারতের পর্যটন শিল্প।
কিন্তু যেই মানুষগুলোর উপর দাঁড়িয়ে এই শিল্প, তাদের কথাও যেন ভাবে দেশের বাকি সমস্ত মানুষেরা।
Be First to Comment