Press "Enter" to skip to content

ভারতবর্ষে অন্যধারার ছবির প্রথম প্রতিনিধি বলরাজ সাহানি। বিবিসিতে চার বছর হিন্দি ঘোষকের ভূমিকায় ছিলেন….

Spread the love

———-জন্মদিনে স্মরণঃ বলরাজ সাহানি———

বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, তিনি ভারতের গ্রেগরি পেক নন, চার্লি চ্যাপলিনও নন৷ শাম্মি কপুরের মতো নাচ তাঁর অসাধ্য ছিল৷ রাজেন্দ্র কুমারের মতো সিলভার জুবিলি হিরোও ছিলেন না৷ কিন্তু ‘সবার পিছে, সবার নীচে, সব হারাদের মাঝে’ থেকে, তাঁদের চরিত্র চিত্রণে তিনি ছিলেন অদ্বিতীয়৷ ভারতে অন্যধারার ছবির প্রথম প্রতিনিধি তিনিই৷ তিনি বলরাজ সাহানি ৷১৯৭৩ সালের ৪ মে সংখ্যায় ‘ফিল্মফেয়ার’ তাঁকে নিয়ে প্রচ্ছদ কাহিনি করে। নীচে ক্যাপশন ছিল ‘হি ওয়াজ আ মিসফিট ইন ফিল্মস’ (ফিল্মে বেমানান) ৷ তাই বোধ হয়, বলরাজ তাঁর আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন, ‘গীতা বালী আজকাল প্রায়ই অভিযোগ করে যে আমার মত কালামুখ অভিনেতা ছাড়া তার আর নায়ক জোটে না৷’ বলরাজের আসল নাম যুধিষ্ঠির ৷ বাবা হরবংশ লাল। মা লক্ষ্মী দেবী ৷ হরবংশ লালের ছিল অর্ডার-সাপ্লাইয়ের ব্যবসা৷ অন্যদিকে, তিনি ও তাঁর পরিবারের সবাই ছিলেন আর্য সমাজে দীক্ষিত ৷ এই কারণে বালক বলরাজকে প্রথমে ভর্তি করা হয় গুরুকুলে৷ কিন্তু সেখানে নিয়মের দাসত্ব করতে মন সাড়া না দেওয়ায় বাবার কাছ থেকে প্রথাগত স্কুলে পড়ার সম্মতি আদায় করে নেন৷ স্কুলের পাট চুকিয়ে বলরাজ লাহোরে গভর্নমেন্ট কলেজ থেকে ইংরেজিতে বিএ এবং এমএ পাশ করেন৷ সেখানকার উদার ও আধুনিক পরিবেশ তাঁর জন্য অনুঘটকের কাজ করে৷ লেখালেখি, অভিনয় ডানা মেলে এখান থেকেই ৷ সপ্তাহে অন্তত তিনটি করে বিদেশি ছবি দেখা ছিল অবশ্য কর্তব্য ৷ ‘পিকচারগোয়ার’ ফিল্ম পত্রিকার সঙ্গে পরিচয় তখনই৷ ১৯৩৬ সালে লাহোর কলেজের অধ্যাপক যশবন্ত রাইয়ের বোন দময়ন্তীকে বিবাহ করেন৷ বন্ধুদের ডাকে লাহোরে গিয়ে ‘মানডে মর্নিং’ নামে একটি নতুন সাপ্তাহিকে যোগ দেন৷ ‘মানডে মর্নিং’ আশানুরূপ সাফল্য না পাওয়ায়, দু’মাসের মধ্যেই বলরাজ কাজ খুঁজতে থাকেন৷ অবশেষে ১৯৩৭-এর শীতে হিন্দির অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করলেন বিশ্বভারতীতে৷ মাইনে মাসে চল্লিশ টাকা৷ দময়ন্তী, যিনি দাম্মো নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন, শান্তিনিকেতনে এলেন ছাত্রী হিসেবে৷ ওই সময়ই শান্তিনিকেতনে বলরাজের নির্দেশনায় একবার জর্জ বার্নাড শ’এর ‘আর্মস অ্যান্ড দ্য ম্যান’ মঞ্চস্থ হয়৷ তিরিশের দশকের শেষাশেষি গান্ধীজির নয়ি তালিম (নতুন শিক্ষাক্রম) বলরাজকে অনুপ্রাণিত করে৷ তিনি ১৯৩৯ সালে সস্ত্রীক চলে যান ওয়ার্ধার সেবাগ্রাম আশ্রমে৷ এখানে প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষার উপরেও জোর দেওয়া হত৷ গান্ধীজির সঙ্গে মাঝেমাঝে দেখা হওয়াটাও ছিল এই কাজের বড় আকর্ষণ৷ ১৯৪০৷ তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে৷ মিত্রশক্তির কর্মকাণ্ড প্রচারের জন্য বিবিসি লন্ডনে হিন্দি কার্যক্রম চালু করার সিদ্ধান্ত নিল৷ সেই কাজের জন্য সাহানি দম্পতিকে গান্ধীজির কাছ থেকে চেয়ে নিলেন ভারতে বেতার সম্প্রচারের প্রাণপুরুষ লায়োনেল ফিল্ডেন৷ শিশুপুত্র পরীক্ষিতকে মা-বাবার কাছে রেখে বলরাজ দাম্মোকে নিয়ে পাড়ি জমালেন লন্ডনে৷ চার বছর বিবিসিতে হিন্দি ঘোষকের ভূমিকায় ছিলেন সাহানি দম্পতি। সেখানে থাকার সময় স্ক্রিপ্ট রচনাতেও হাত পাকিয়ে ছিলেন দুজনে৷ পছন্দ হয়েছিল ব্রিটিশ রঙ্গমঞ্চের দুই নাইট, লরেন্স অলিভিয়ের এবং জন গিলগুডের অভিনয় রীতি৷ বাড়ির কাছেই, টটেনহ্যাম কোর্ট রোডে ছিল একটি সিনেমা হল৷ এখানেই রাশিয়ান ছবির সঙ্গে বলরাজের পরিচয় হয়৷ বর্ণবৈষম্যের প্রেক্ষাপটে নির্মিত রাশিয়ান ছবি ‘সার্কাস’ দেখার পর বলরাজ ফিল্মের ব্যাপারে আরও আগ্রহী হয়ে ওঠেন৷ ‘৪২-এর আন্দোলন পরবর্তী ভারতের অবস্থা, তেতাল্লিশের দুর্ভিক্ষ, পুত্রের জন্য মন কেমন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ঘিরে অনিশ্চয়তার বাতাবরণ– এই সবের নিট ফল ১৯৪৪-এ সাহানি দম্পতির দেশে ফিরে আসা৷

বলরাজ দেশে ফেরার পর সাহানি দম্পতি রীতিমত ইন্টারভিউ দিয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সাংস্কৃতিক শাখা আইপিটিএ-র সদস্য হলেন৷ একই সময়ে, চেতন আনন্দ, বলরাজ ও দাম্মোকে তাঁর ছবি, ‘নীচা নগর’-এ অভিনয়ের প্রস্তাব দিলেন৷ আইপিটিএ’র প্রাণপুরুষ ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যোশি৷ তাঁর উত্‍সাহে বলরাজ অভিনয়, নির্দেশনা এবং নাটক রচনায় নিজেকে পুরোপুরি সঁপে দিলেন৷ সঙ্গে পেলেন গুজরাটি অভিনেতা যশবন্ত ঠক্কর, মারাঠি তামাশা শিল্পী আন্নাভাউ শাঠে এবং লোকগায়ক অমর শেখকে৷ সহযোগী হিসাবে এলেন শান্তি বর্ধন, রবিশঙ্কর, পৃথ্বীরাজ কপুর, দুর্গা খোটে, প্রেম ধবন এবং আরো অনেকে৷ ‘নীচা নগর’ এর শ্যুটিং শুরু করতে কিছু আর্থিক অসুবিধা থাকায় চেতন বলরাজকে নিয়ে যান চিত্র পরিচালক ফণি মজুমদারের কাছে৷ তাঁর পরিচালনাতেই বলরাজের ছায়াছবিতে প্রবেশ৷ প্রথম দুটি ছবি ‘জাস্টিস’ ও ‘দূর চলেঁ৷’ অভিনয়ের অভিজ্ঞতা সুখকর না হলেও, বলরাজ পান এক সহমর্মী বন্ধু, চরিত্রাভিনেতা ডেভিড এব্রাহামকে৷ সেই সময় ব্রিটিশ সরকার ছবি তৈরি করার জন্য লাইসেন্স দিত৷ আইপিটিএও ছবি তৈরিতে আগ্রহী হয় এবং লাইসেন্সও পেয়ে যায়৷ বিজন ভট্টাচার্যের নাটক ‘নবান্ন’ ও ‘জবানবন্দী’ এবং কৃষণ চন্দরের গল্প ‘অন্নদাতা’ অবলম্বনে তৈরি হল ব্রিটিশ সরকারেরই কুশাসনের জীবন্ত দলিল ‘ধরতি কে লাল৷’ পরিচালনায় কে এ আব্বাস৷ মূল চরিত্রে বলরাজ ও দময়ন্তী সাহানি। সঙ্গে শম্ভু ও তৃপ্তি মিত্র, জোহরা সেহগল, আইপিটিএ’র অন্যান্য শিল্পীরা এবং ধুলিয়া জেলা কিষাণ সভার সদস্যরা৷ সঙ্গীত পরিচালনায় পণ্ডিত রবিশঙ্কর৷ পঞ্চাশের দশক৷ চল্লিশ ছুঁই-ছুঁই বলরাজ চিত্রজগতে তখনও স্থায়ী জায়গা নিতে পারেননি৷ পরিবারে অভাব লেগেই আছে৷ কাজ আসে মাঝে মাঝে৷ গুরু দত্ত পরিচালিত, দেব আনন্দ অভিনীত ‘বাজি’ ছবির চিত্রনাট্য লিখলেন ছ’মাস ধরে৷ অন্যদিকে, কমিউনিস্ট পার্টির লাইন মেনে, কিছুটা ইচ্ছের বিরুদ্ধেই, নেহরুকে সমালোচনা করে বলরাজ লেখেন প্রহসন ‘জাদু কি কুর্সি৷’ এটি আইপিটিএ’র ব্যানারে বহু জায়গায় অভিনীত হয় এবং নেহরু সরকারের কোপেও পড়ে৷ তাঁর ছ’মাস হাজতবাস হয়৷ তিন দশকের ফিল্ম জীবনের প্রথম দশকে বলরাজ সুযোগ পান মাত্র দশটি ছবিতে৷ পরের দুই দশকে অভিনয় করেন একশো কুড়িটির মতো ছবিতে৷ ১৯৫৩ সালে বিমল রায় পরিচালিত ‘দো বিঘা জমিন’ তাঁর জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দেয়৷

বিমল রায়ের সহকারী হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায় তাঁকে ছবির সারাংশ পড়ে শোনান৷ নির্বাচিত হওয়ার পর বলরাজ বোম্বাইয়ের যোগেশ্বরী অঞ্চলে গিয়ে বিহার-উত্তর প্রদেশ থেকে আসা ‘ভাইয়া’দের জীবনধারা লক্ষ্য করতে থাকেন৷ শিখে নেন তাদের ধুতি ও পাগড়ি পরার ধরণ, কথা বলার কায়দা৷ রপ্ত করেন রিক্সা চালানোর কৌশল৷ এরপর বলরাজ যেমন একদিকে ‘কাঠপুতলি’, ‘অনুরাধা’, ‘সীমা’, ‘কাবুলিওয়ালা’ বা ‘গরম হাওয়া’র মতো অন্য ধারার ছবি করেছেন, অন্যদিকে দর্শকমন জিতে নিয়েছেন ‘ওয়াক্ত’, ‘এক ফুল দো মালি’, ‘দো রাস্তে’ বা ‘মেরে হমসফর’-এর মতো বাণিজ্যিক ছবিতেও৷ তাঁর লিপে মান্না দে’র বহু গান অমর হয়ে আছে৷ অভিনয়ের পাশাপাশি বিশ্বনাগরিকও ছিলেন বলরাজ৷ রাশিয়া ও পাকিস্তান সফরের ফসল তাঁর দু’টি ভ্রমণ কাহিনি৷ পেয়েছেন পদ্মশ্রী ও সোভিয়েট ল্যান্ড নেহরু পুরস্কার৷ কাশ্মীর ছিল সবচেয়ে প্রিয় বেড়াবার জায়গা৷ ‘শায়র-এ-কাশ্মীর মহজুর’ নামে প্রথম কাশ্মীরী ছবির প্রযোজকও ছিলেন বলরাজ৷ জীবনে একটিই ছবি, ‘লাল বাত্তি’, পরিচালনা করেন৷ নায়িকা ছিলেন মালা সিনহা৷

শেষ জীবনে আসে বড় আঘাত৷ দেহে জমাট বাঁধে নানা রোগ৷ ১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন৷

বলরাজ সাহানি ১৯১৩ সালের আজকের দিনে (১ মে) অবিভক্ত পাঞ্জাবের রাওয়ালপিন্ডিতে জন্মগ্রহণ করেন।

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.