বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ‘বঙ্গাল কে শের’। অমলজ্যোতি ঘোষকে এ-নামটা দেন বড়ে গোলাম আলি। তখন অমলজ্যোতি ঘোষ ‘পান্নালাল ঘোষ’ নামেই খ্যাত। পান্নালাল ঘোষ সেই মানুষ, যিনি ভারতের রাগ সঙ্গীতে যে বাঁশি বাজানো যায়– তা দেখান। বাঁশিটা তিনি শেষজীবন অবধি বয়ে বেড়ালেন। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের আসর থেকে নৌশাদের মুঘল-এ–আজম পর্যন্ত। পান্নালাল ঘোষ বাংলাদেশের বরিশালে ২৪ জুলাই ১৯১১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার ডাকনাম অমলজ্যোতি ঘোষ। তার পিতা, অক্ষয় কুমার ঘোষ ছিলেন একজন সেতার বাদক। ছোটো থেকে কী কী শিখলেন পান্নালাল-কণ্ঠসঙ্গীত, সেতার, পাখোয়াজ, তবলা, বাঁশি, বক্সিং, জিমন্যাস্টিক। স্বাধীনতা আন্দোলনের জেরে তৎকালীন হুজুরদের রক্তচক্ষুর ফলে সতেরো বছর বয়েসে এলেন কলকাতায়। তখনও সিনেমার মুখে বোল ফোটেনি। কিন্তু সিনেমার সঙ্গে কনসার্ট বাজানোর চল ছিল স্টেজের পেছনে। পান্নালাল বাঁশি বাজাবার কাজ পেলেন। তিনি অনুভব করলেন, শুধু সঙ্গত করে পেট ভরলেও মন ভরছে না। তিনি রাগ সঙ্গীত বাজানোর তালিম শুরু করলেন– তিনবছর টানা চললও। ইতোমধ্যে তাঁর বাবা অক্ষয়কুমার ঘোষ, মারা গেলেন। বাবা আলাউদ্দিনের কাছে ১৯৪৬ সালে শেখার ইচ্ছে প্রকাশ করলেন। আলাউদ্দিন দেড় বছর শেখালেন পান্নালাল ঘোষকে। পঁয়ত্রিশ বছরের পান্নালাল ততদিনে বোম্বে গিয়ে কাজও করেছেন। বাঁশির জনপ্রিয়তা দেখে ওঁর ছাত্রই ওঁকে বোম্বে যাওয়ার জন্যে বলেন।
এতকিছুর মধ্যে ১৯৩৮ সাল নাগাদ তাঁর ইউরোপ ট্যুর হয়ে গেছে। যা সে সময়ের নিরিখে বিরাট ও বিরল। পান্নালাল ঘোষের জীবন দেখলে একটা কথা বোঝা যায়, তিনি একটা ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলেন, বাঁশিকে সম্বল করে। নিয়মিত চর্চা করে, পথ তৈরি করে, পথ বদল করে একটা শেপ দিতে চেয়েছিলেন হয়তো বাঁশিকে। কিন্তু বাঁশিটাকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে প্রসার করে পান্নালাল দেখালেন যে, বাঁশিতেও রাগসঙ্গীত বাজানো যায়। যার ফলে পরে আমরা দেখলাম ওঁর ছাত্র বা ছাত্র নন এমন অনেকেই বাঁশিকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। পান্নালাল ঘোষ হয়তো থিতু হতে পারেননি কোথাও। সৃষ্টিশীল মানুষদের ক্ষেত্রে এটা বিরল নয়। প্রবল খ্যাতি অথচ আর্থিক দুর্দশায় গেলেন বোম্বে, সিনেমায় কাজও করলেন কিছু, কিন্তু মনে হল যেন সুরে বাজছে না। চলে এলেন। ১৯৫৬ সাল নাগাদ আকাশবাণীতে বেশ কিছু অর্কেস্ট্রা উপহার দিলেন– কলিঙ্গবিজয়, ঋতুরাজ। পান্নালাল রাগ চর্চার বাইরেও নিজে রাগ সৃষ্টি করলেন– নূপুরধ্বনি, দীপাবলি। এমনও দিন গেছে, পান্নালালের দারিদ্র্যের খবর পেয়ে ভারতের তথ্য সম্প্রচার মন্ত্রী বালাসাহেব বিশ্বনাথ কেসকার নিজে কলকাতায় এসে তাঁকে চাকরি দিয়ে দিল্লি নিয়ে যান। পান্নালাল ঘোষের ছাত্র ছিলেন দেবেন্দ্র মুরুদেশ্বর (যিনি ওঁর জামাইও বটে), গৌর গোস্বামী, ভি জি কার্নাড, মুকুল রায়, ফকিরচন্দ্র সামন্ত সহ বহু মানুষ। শুধু গায়কী অঙ্গই নয়, তন্ত্রকারী অঙ্গেও সমান দক্ষতা ছিল ওঁর।
পান্নালাল ঘোষ ১৯৬০ সালের ২০ এপ্রিল মাত্র ৪৮ বছর বয়সে নতুন দিল্লিতে মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment