সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় :গত বছরের শেষমাসে বালুরঘাট শহর জুড়ে পোস্টারে পোস্টারে ছয়লাপ। সারা ভারত মাতাল ফেডারেশন এর পক্ষে বোতলবাবা সভা ডেকেছেন ছাব্বিশ ডিসেম্বর। পোস্টারে লেখা ইংলিশ বাংলা প্যাকেট চুল্লু ঐক্য জিন্দাবাদ। কোনো পোস্টারে লেখা কলকাতার ব্রিগেডে হবে সারা ভারত মাতাল ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভা।
কিছু পোস্টারে জানানো হয়েছে সাত দফা দাবি। এক) মাতালদের বাড়ির লোক বা পুলিসের আপত্তি করা চলবে না দুই) যেখানে খুশি মদ খাওয়ার ব্যাপারে বাধা দেওয়া চলবে না। তিন) মদ খাওয়ার জন্য অসুস্থ হলে বিনামূল্যে সরকারি ও বেসরকারি চিকিৎসা করতে হবে।চার)বৃদ্ধ হলে পেনশন দিতে হবে। এমন নানা দাবি। বিশ্বাস হচ্ছে না ? খবর একদম সত্যি। বালুরঘাট প্রশাসন এখন বোতলবাবা আর পোস্টার কে বা কারা সেঁটেছে তাঁদের খোঁজা চলছে।
আসলে অঘটন আজও ঘটে। কিন্তু যে বোতল নিয়ে এই ঘটনা সেই বোতলপ্রেমীদের সংখ্যা নতুন বছরের শীতের আমেজে অনেকটাই বেড়ে যায়।
নতুন বছরে বাঙালি একটু রসেবশে থাকবে না তাই কখনও হয়? যাঁরা বছরভর সুরারসে নিজেকে বঞ্চিত রাখেন তাঁরাও চরিত্রকে ছাড় দেন। চিরকুমার সভায় রবীন্দ্রনাথ তো বলেছেন, দেশে অন্নজলের ঘোর অনটন, খাও হুইস্কি – সোডা আর মুরগি মটন অন্যত্র আবার বলেছেন, অভয় দাও তো বলি আমার উইশ কি, একটি ছটাক সোডার জলে বাকি তিন পোয়া হুইস্ক এমনকি স্বয়ং বিবেকানন্দ ও উইলসন হোটেলে চেখে দেখেছেন ‘ সখি সুরা কাহারে বলে। এভারেস্টের দৈর্ঘ যেমন মেপেছেন, তেমন কত পেগে নেশা হয় সেটাও মেপে দেখতেন রাধানাথ শিকদার ঠাকুর পরিবার নিয়ে চর্চা ছিল ওঁরা মদে আর দুধে থাকেন বলে ফর্সা গায়ের রং। মধুকবি থেকে কালীপ্রসন্ন, বঙ্কিম থেকে শরৎ, হেমচন্দ্র থেকে দুই সমরেশ, সুনীল থেকে শক্তি কে না আছেন সুরাপ্রেমীর দলে? তবে রামমোহন ছিলেন সংযত। একবারই জীবনে বন্ধুর পাল্লায় পড়ে মাতাল হয়েছিলেন।
বাংলায় কিন্তু মদের ঐতিহ্য আছে। বাংলাকে বলা হতো গৌড়, গৌড় শব্দ গুড় থেকে। গুড় থেকে হতো মদ। ভাতপচিয়েও মদ তৈরিতে বাংলার ভারত জোড়া নাম আছে। ইংরেজরা বাংলা খেতেন হুইস্কি মিশিয়ে। নাম ছিল পাঞ্চ। পাঞ্চ থেকে পাব। তবে এদেশে হুইস্কির আগে এসেছে বিয়ার। উনিশ শতকে ওষুধের দোকানে মিলতো মদ। নিষিদ্ধ পল্লীতেও ছিল মদের চাহিদা। বাবু কালচারের ফলে ওপাড়ার মেয়েরাও মদে মত্ত হয়ে পড়ে। পিছিয়ে যাই চলুন পৌরাণিক যুগে। মদের ছিল অষ্টোত্তর শতনাম। সোম, মদ্য,মদিরা,মধুসাধু , আসব, বারুনী ,কাদম্বরী ইত্যাদি ছিল মদের আড্ডা। বলা হতো পান গোষ্ঠীকা বা আসান। পান পাত্রেরনাম চষক, সরং,অনুতর্শন। কালীপূজোতে যে মড়ার খুলিতে দেবীকে মদ পরিবেশন করা হয় তাকে বলে মহাপাত্র। কয়েৎবেল, খেজুর, তাল থেকেও মদ তৈরি হতো। পুরাণে সোমরসের উল্লেখ আছে। সোমলতার রস মেষের লোমে তৈরি ছাঁকনিতে ছেঁকে গো চর্মের পাত্রে দশ দিন ধরে জাড়ানো হতো। মেশানো হতো ঘি,দুধ,দই,ক্ষীর,ও ভাজা জব। ধান থেকে তৈরি মদ কে বাংলায় বলে ধেনো। আয়ুর্বেদে চুরাশি রকমের মদের উল্লেখ আছে। লকুলার্ণব তন্ত্রে আমের রসের মদ খেলে বিদ্বান হওয়ার বিধান আছে। রতিক্রিয়ার জন্য তাড়ি খেতে বলা হয়েছে। রামায়ণে বলা হয়েছে সীতার প্রিয় ছিল মৈরেয় মদ। উত্তর কাণ্ডে শ্রীরাম সীতার হাতে মৈরেয় তুলে দিয়ে বলছেন, সীতামাদায়ে হস্তেন মধু মেরেয়কা শুচি। মহাভারতের উদ্যোগ পর্বে আছে, সঞ্জয় এসেছেন কুরুদের দূত হয়ে, কিন্তু মাতাল কৃষ্নার্জুন অতিথি আপ্যায়ন করতে পারলেন না, কৃষ্ণের দুই পা অর্জুনের কাঁধে, অর্জুনের এক পা দ্রৌপদীর কোলে, আর এক পা কৃষ্ণপত্নী সত্যভামার কোলে।
ব্রিগেড প্যারেডে বিশ্ব মাতাল সম্মেলন?
More from GeneralMore posts in General »
Be First to Comment