————-জন্মদিনে স্মরণঃ নিমাই ঘোষ———–
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ছোট্ট একটি ক্যানন কিউএল ১৭ ক্যামেরা কী ভাবে একটি মানুষকে কিংবদন্তী করে তুলতে পারে, তার উদাহরণ আলোকচিত্রী নিমাই ঘোষ। বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম আলোকচিত্রী কার্তিয়ের ব্রেসঁ যাঁর সম্বন্ধে বলেছিলেন ‘রে’জ ফটোগ্রাফার’। পদ্মশ্রীপ্রাপ্ত সেই আলোকচিত্রী সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন ১৯৬৮-১৯৯২ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৪টি বছর। সত্যজিৎ রায়ের এক-একটি বিখ্যাত ছবির হয়ে ওঠার পর্বগুলি কী রকম ছিল, সেই সব দৃশ্য বিশ্ববাসী চাক্ষুষ করতে পেরেছেন তাঁরই একনিষ্ঠ ক্যামেরার সৌজন্যে। রামপুরহাটের কাছে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির আউটডোর শুটিংয়ে তাঁর সঙ্গে সত্যজিৎ রায়ের যে যুগলবন্দিটি শুরু হয়েছিল, তা শেষ হল সত্যজিতের শেষ ছবি ‘আগন্তুক’-এ এসে। এই দীর্ঘ সময়কালে অজস্র বিরল এবং শিল্পসমৃদ্ধ ছবি তুলে রাখা যদি নিমাই ঘোষের আশ্চর্য কৃতিত্বের একটি দিক হয়, তা হলে অন্য দিকটি হল সেই সমস্ত ছবি অতুলনীয় অধ্যবসায়ে সংরক্ষণ করে যাওয়া জীবনের অন্তিম পর্ব পর্যন্ত। এমন নিপূণ এবং বিজ্ঞানসম্মত ভাবে ছবিগুলির সংরক্ষণ না হলে সে সবের অধিকাংশই হয়তো তলিয়ে যেত বিস্মৃতিতে।
সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ এতটাই প্রসিদ্ধ যে তার আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এমন বেশ কিছু তথ্য যা নিমাই ঘোষকে চিনতে সাহায্য করে। ব্যক্তি হিসেবে যেমন, তেমনই আলোকচিত্রী হিসেবে বটেই। উৎপল দত্ত পরিচালিত ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ সংক্ষেপে এলটিজি-র বিভিন্ন স্মরণীয় নাটকে নিমাই ঘোষ অভিনয় করেছিলেন। সেই সব নাটকের মধ্যে আছে ‘অঙ্গার’, ‘ফেরারি ফৌজ’, ‘ওথেলো’ এবং ‘নীচের মহল’। রবি ঘোষ পরিচালিত ‘চলাচল’ নাট্যগোষ্ঠীর নিয়মিত অভিনেতা ছিলেন নিমাইবাবু। সেই সূত্রেই বংশী চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে তাঁর আলাপ এবং দুরুদুরু বুকে ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবির আউটডোর শুটিংয়ে প্রবেশ। বাকিটুকু নিঃসন্দেহে ইতিহাস। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ কিন্তু প্রায় ভুলে যাওয়া একটি তথ্য হল এই যে যামিনী রায়, রামকিঙ্কর বেজ এবং বিনোদবিহারী মুখোপাধ্যায়ের মতো অসামান্য শিল্পীর কর্মকাণ্ড অতি যত্নে তুলে রেখেছিলেন নিমাই ঘোষ।
একই নিষ্ঠায় ধরে রেখেছিলেন শহর কলকাতার বিভিন্ন ছবি, আবার ভারতের বিভিন্ন দুর্গম স্থানে বসবাসকারী প্রজাতিদের জীবনযাত্রাও। বাংলা নাটকেরও বেশ কয়েক দশকের ইতিহাস ধরা আছে তাঁর তোলা বিভিন্ন ছবিতে। দেশ-বিদেশ মিলিয়ে ছবির প্রদর্শনী হয়েছে অজস্র। তারই মধ্যে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য ১৯৯১ সালে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তাঁর প্রদর্শনী এবং ১৯৯২ ও ১৯৯৩ সালে যথাক্রমে ফ্রান্সে এবং ব্রিটেনে তাঁর প্রদর্শনী যেখানে যেখানে স্বয়ং কার্তিয়ের ব্রেসঁ-র ছবির পাশেই উজ্জ্বল হয়ে ছিলেন ভবানীপুরের নিমাই ঘোষ। স্বীকৃতি এসেছিল প্রচুর। ২০০৭-এ তিনি ছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের অন্যতম জুরি। তাঁর বিভিন্ন বই যেমন ‘সত্যজিৎ রে অ্যাট সেভেন্টি’, ‘ড্রামাটিক মোমেন্টস’, ‘বেয়ারফুট লাইট’, ‘সত্যজিৎ রে: আ ভিশন অফ সিনেমা’, ‘উত্তম মুহূর্ত’, ‘মানিকদা: মেমোরিজ অফ সত্যজিৎ রে’ প্রভৃতি থেকে গেল উত্তরকালের জন্য, তেমনই রয়ে গেল সত্যজিৎ রায় ছাড়াও বাংলা নাটক, দেশজোড়া বিভিন্ন শিল্পী ও ভাস্করের কর্মকৃতি, নগর কলকাতা কিংবা বস্তার এবং গুজরাটের বোন্ডা পাহাড় অঞ্চলের অধিবাসীদের জীবনযাপনের অন্তরঙ্গ ছবি।
বয়স তাঁকে অশক্ত করেছিল, কাবু করতে পারেনি। ক্যামেরা হাতে নিলেই তিনি চোখের পলকে সেই আটষট্টি সালের ঝকঝকে তরুণ। ছিয়াশি বছর বয়সেও সেই তারুণ্য নিয়ে নিজেই ছবি হয়ে গেলেন কিংবদন্তী এই আলোকচিত্রী।
এই বিশ্ববিখ্যাত আলোকচিত্রী ২৫ মার্চ ২০২০ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
নিমাই ঘোষ ১৯৩৪ সালের আজকের দিনে (৮মে) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment