#শৈশবে র আনাগোনা য় দুঃস্বপ্ন হয়ে আসে শিশু শ্রমিকের কান্না।#
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ১২ জুন, ২০২০।
শিশুর জীবন হোক স্বপ্নময়, শ্রমের জালে বন্দী হয়ে নয়- এমনটাই অঙ্গীকার থাকে, প্রতি বছর বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবস উদযাপন এর প্রাক্কালে। তারপর আর কে খেয়াল রাখে? ছোটু, ছুটকি, আশা, মিনা, রাজু এমন অনেককেই ফাইফরমাশ খাটিয়েই চলতে থাকে আমাদের সুভদ্র সমাজ। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “শিশুরা হচ্ছে এমন এক প্রকার প্রানী যারা নিজেরা নিজেদের জগত তৈরি করে। “কিন্তু নিজেদের জগত তৈরি হওয়ার অনেক আগেই অর্থ নৈতিক দুরাবস্থার চাপে পরিবার কে সাহায্য করতে রোজগারের পথে নামতে বাধ্য হয়।
অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, বিশ্বের মধ্যে ভারতেই শিশু শ্রমিকের সংখ্যা সবথেকে বেশি। আদমশুমারি অনুযায়ী, ভারতে শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটি থেকে প্রায় ১২কোটি। তবে প্রকৃত সংখ্যা হিসেব করলে এর চেয়ে বেশি যা লোকচক্ষুর আড়ালেই থেকে যায়। আজ ১২ই জুন বিশ্ব শিশু শ্রম বিরোধী দিবসে আরেকবার ফিরে দেখা, শিশু শ্রমিকের বর্তমান চিত্রটি কেমন। সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, দারিদ্র্য আর সামাজিক সুরক্ষার অভাবই শিশু শ্রমের অন্যতম কারণ।
উন্নত দেশগুলো তে যে সামাজিক সুরক্ষা আছে, ভারতের মতো উন্নতিশীল দেশে তার বিন্দু বিসর্গ নেই। ধনী দরিদ্রদের ব্যবধান, উদার অর্থনীতির কারনে বেসরকারি করন, সামাজিক সম্পদের অনিয়মিত সরবরাহ, স্বাস্থ্য সুরক্ষা র অভাব- সমাজের একটা অংশ হয়ে পড়ছে বেকার, যার কোপ গিয়ে পড়ছে শিশুর জীবনে। সর্বজনীন শিক্ষা বা বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত দারিদ্র সীমার নিচে থাকা বাবা-মা তার নাবালক ছেলে মেয়ে কে একমুঠো অন্ন সংস্থানের তাগিদে কাজে পাঠাতে বাধ্য হচ্ছে। এছাড়াও, একটা অংশ প্রাকৃতিক দুর্যোগে, বা বিশেষ কারনে বাস্তূহারা হয়ে কাজের সন্ধানে এসে শিশু শ্রমিক এ পরিণত হয়। খাতায় কলমে সরকারি ব্যবস্থাপনায় কোনও খামতি নেই।
১৯৮৬ সালে শিশু শ্রম রোধ ও নিয়ন্ত্রণ আইন শিশু শিক্ষার অধিকার কে নিশ্চিত করলেও শিশু শ্রমিকের বর্তমান পরিস্থিতি খুব ই হতাশা জনক। শিশু শ্রমিক নিয়ে কাজ করা অন্যতম সংস্থা CRY গতবছর যে রিপোর্ট দিয়েছে, তা অত্যন্ত চিন্তার ও উদ্বেগের। ভারতে শিশু শ্রমিক কমার হার মাত্র ২.২শতাংশ। এই হারে কমলে একশ বছর লাগবে শিশু শ্রমিক মুক্ত ভারতবর্ষ পরিণত হতে। এই প্রেক্ষিতে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি ও জন নায়ক নেলসন ম্যান্ডেলা বলেছিলেন, সমাজ কিভাবে শিশুদের প্রতি আচরন করবে, তার মধ্যে দিয়ে সমাজের চেহারা ফুটে ওঠে। ভারতের ক্ষেত্রেও তার ই প্রতি ফলন ঘটছে।
নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রাপক কৈলাশ সত্যার্থী ও মালালা ইউসুফ জাই দুজনের অবদান শিশুদের অধিকার রক্ষার লড়াই এর ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। এদের সংগঠন “বচ্পন বাঁচাও” আন্দোলন শিশু শ্রমিকদের নিদারুণ অবস্থা থেকে মুক্ত করে মূলধারায় এনে তাদের অধিকার, শিক্ষার ব্যবস্থার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন কাজ করলেও, শিশু শ্রম বিরোধী পরিবেশ যতটা আলোকিত হওয়ার ছিল তা হলো না। আসলে দরকার রাষ্ট্রের সদিচ্ছা। কাজটা হলো, মানব ক্ষমতা বৃদ্ধি র ভিতর দিয়ে সমাজের সকল শিশুর সামাজিক সুরক্ষা অর্থাৎ, তার পুষ্টি, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, শিক্ষার বিষয় গুলি কে প্রাধান্য দেওয়া। সকলের চেষ্টা করা উচিত রাজনৈতিক বিভেদ ভুলে ব্লক স্তর থেকে এই উদ্দেশ্য সফল করার।
মনে রাখা উচিত, শিশুর প্রতি এই নঞর্থক দৃষ্টি ভঙ্গি, অবহেলা, বঞ্চনার উপর নির্ভর করে দেশের অর্থনীতির নৈতিক ভিত্তি কখনো শক্ত হয় না। আইনের চোখে সকলের অধিকার সমান কিন্তু, আইন সবার জন্য কতটা সমান? শিশু শ্রম তো আইনত নিষিদ্ধ, সে আইনই বা সকল শিশুর জন্য কতটা সমদর্শী? আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা র নির্দেশিত এই দিনটি র গুরুত্ব ক্রমশই ফিকে হয়ে আসছে বলেই মনে হয়।
Be First to Comment