মানবজীবনে সূর্যালোকের প্রভাব ও উপকারিতা…
মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ৩০মে, ২০২০।
সূর্য- আমাদের সৃষ্টি র উৎস। প্রতিদিন ভোরবেলায় ঘুম থেকে উঠে পূব দিকে তাকালে যে আগুন গোলাটি আকাশের গায়ে দেখি তা একটি তারা বা রেডিও আ্যকটিভ চুল্লি। তার তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ছটায় আমরা যে আলোকিত হতে পারি তাকে বলে সূর্যালোক। বিঞ্জানের ভাষায় ইলেকট্রোম্যাগনেটিক বিকিরন। এর বেশি গভীরে না গিয়ে এটুকু বলতে পারি আলো ই আমাদের সজীব রাখে। মূলত, ভারতীয়রা চনমনে সূর্যালোকের দেশের বাসিন্দা। কিন্তু গ্ৰীষ্মের প্রখর রোদের উত্তাপ আমাদের যে ভাবে অনুভব করতে হয় তা অত্যন্ত কষ্টের। পিচ গলা রোদ্দুর, চিড়বিড়ে গরম, রেকর্ড টেম্পারেচার এর ভয়বহতা আমাদের এত যন্ত্রনা দেয় যে সূর্যালোকের উপকারিতার কথা মনে রাখতে ইচ্ছা করে না। অথচ, বিদেশিরা সাত সমুদ্র তেরো নদী পেরিয়ে ক্রান্তীয় অঞ্চলে পারি দেন সানবাথ বা সূর্যালোক গায়ে মাখবার জন্য। অথচ, আমাদের মতো গ্ৰীষ্ম প্রধান দেশে রোদ ঝলসানো প্রকৃতিকে মেনে নিতে হয়। কারণ, গ্ৰীষ্ম প্রধান দেশে ইউ ভি রশ্মি বা অতিবেগুনী রশ্মির দাপট সহ্য করতে হয় সকাল নটা থেকে বিকাল তিনটা পর্যন্ত।
আপনার ছায়া আপনার চেয়ে যত খাটো ততই সূর্যালোক প্রখর। এর সবচেয়ে প্রভাব পরে ত্বকের উপর। অতি বেগুনি রশ্মির জন্য ত্বকে সান ট্যান, সানবার্ন, চুলকানি, ঘামাচি ইত্যাদি র সমস্যায় সকলেই নাজেহাল। সেই কারণে ছাতা, সানগ্লাস, গা ঢাকা জামা, ব্যবহার করতে হয় সূর্যালোক কে আড়াল করতে। যে দেশে বছরে আট মাস গ্ৰীষ্ম, সে দেশে রোদে পোড়ার হাত থেকে বাঁচতে গিয়ে সানবাথের উপকারীতার কথা মনে থাকে না। তবুও, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির প্রভাবে গত কয়েক দশক ধরে এদেশে ও ব্যাপক জনপ্রিয় হয়েছে সানবাথ। আসলে, আমাদের মনের, শরীরের অবসাদ মুক্তি, নানা অসুখ, মনের অসুখ সবকিছুর যন্ত্রনা থেকে মুক্তি দেয় সূর্যালোক। এছাড়াও, আমাদের ত্বকের আভ্যন্তরীণ স্তরে যে কোষ থাকে, তাকে বলে মেলানোসাইট। এরমধ্যে থাকা মেলানিন নামের পদার্থ ত্বকের স্বাভাবিক রঙ ধরে রাখতে সাহায্য করে। সানবাথ নেওয়ার ফলে আলট্রা ভায়োলেট এ, এবং বি মেলানোসাইট থেকে মেলানিন বেরোনো তে সাহায্য করে, ফলে সারা শরীরে ট্যান হয়। ঈষৎ বাদামি ট্যান হওয়া ত্বক ই ভারতীয়দের প্রকৃত বর্ণ। বিদেশি বা সাদা চামরার লোকেদের আমাদের মতো সমান সংখ্যক মেলানোসাইট আছে কিন্তু তাদের ত্বকে মেলানিন নেই বললেই চলে। তাই ওদের ত্বকের ক্যান্সার এর সম্ভাবনা বেশি। তার হাত থেকে বাঁচতে সানবাথ নেওয়ার প্রবনতা। দেশ ও ভৌগোলিক কারন ভেদে সানবাথ নেওয়া র প্রক্রিয়া ও ভিন্ন। উপমহাদেশের মানুষদের শরীরে সানবাথ শরীরে ভিটামিন ডি তৈরি তে সাহায্য করে যা নখ, চুল হাড় মজবুত রাখে।
ক্রান্তীয় অঞ্চলে সানবাথ নিতে হয় যখন ইনফ্রারেড কম থাকে। ভারত পাকিস্তান এ সান বাথ নেওয়া সঠিক সময় সকাল আট টা থেকে দশ টা। বিকাল সাড়ে তিন টে থেকে সাড়ে পাঁচ টা। তবে সানবাথ নেওয়ার সময় অবশ্যই মুখে সানস্ক্রিন লাগিয়ে বসুন। ভারতীয়দের জন্য সান বাথ নেওয়ার কিছু নিয়ম আছে যেমনঃ গলার ভি অঞ্চলে সানস্ক্রিন লাগিয়ে দিন। সানবাথ এর সময় অতি অবশ্যই জল খাবেন, নয়ত ডিহাইড্রেশন এর ভয় থাকে। সানবাথ নেওয়ার সময় বড়ো ছাতার তলায় বসুন। মনে রাখতে হবে, তাপমাত্রার কষ্ট কে বাদ দিলে, সূর্যালোকের উপকারিতা অনস্বীকার্য। যারা নিয়মিত নাইট শিফট এ কাজ করে, তাদের অসময়ে ঘুমানোর অভ্যাস করতে হয়। সেখানে light therapy ঘুম পাড়াতে ওষুধের মতো কাজ করে। মানব শরীরে গুরুত্বপূর্ণ হরমোন টেস্টোস্টেরন, এল এস এইচ, এফ এস এইচ কে সক্রিয় থাকতে সাহায্য করে। যদি নিয়মিত শরীর চর্চা উন্মুক্ত জায়গায় করা যায়, তাহলে সেই মানুষ টি র শরীরের পক্ষেও ভালো। গবেষণায় দেখা গেছে ছোটো বেলায় যারা সূর্যালোক গায়ে মেখেছে, তাদের স্নায়ু জনিত অসুখ হয় না বললেই চলে। নবজাতকের শরীরে বেশি মাত্রায় লোহিত কণিকা ভেঙে যাওয়ার জন্য যে জন্ডিস হয় তার চিকিৎসা হয় সূর্যের আলো দ্বারা। তাই ঐ প্রকার বাচ্চা র ঘরে ষাট ওয়াট ল্যাম্প ব্যাবহার করা হয়। ত্বকের নানা অসুখে আলো দ্বারা চিকিৎসা করা হয়। সোরাইসিস এর চিকিৎসায় PUVA therapy, শ্বেতী বা ভিটিলিগো চিকিৎসায় light therapy করা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন কম সূর্যালোকের দেশে বয়স্কদের মধ্যে মৃত্যু হার বেশি ভিটামিন ডি র অভাবে। এদের রক্তচাপ বেশী থাকে, গা হাত পা এ ব্যাথা বোধ বেশি হয়। সূর্যালোকের সবচেয়ে তাৎপর্য ভিটামিন ডি তৈরীর ক্ষেত্রে। কারন, ভিটামিন ডি র অভাবে বাচ্চাদের রিকেট, বড়োদের অস্টিওম্যালেশিয়া হয়। ভিটামিন ডি কম হলে ক্যালশিয়াম ঘাটতি থাকে, তার ফলে শরীরে যেকোন প্রকার হাড়ের অসুখ আক্রমণ করতে পারে। ভিটামিন ডি একটি প্রো হরমোন, যার অভাবে কোলন, স্তন, প্রস্টেট ক্যান্সার এ আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা থাকে। শিশু বা বয়স্ক যারা বেশী সময় ঘরের ভিতর থাকে, তাদের সূর্যালোকের অভাব জনিত অসুখ গুলি কষ্ট দিতে পারে। সূর্যের উপকারিতা পেতে হলে অবশ্যই সূর্যস্নান নিন। সমুদ্র তটে, সুইমিং পুলের পাশে, বাগানে, বাড়ির ছাদে, শরীরকে যতটা উন্মুক্ত রাখতে পারেন, তত বেশি আলো প্রবেশ করবে। সকালে প্রতিদিন পনেরো মিনিটই যথেষ্ট।
তবে যা কিছু করবেন চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে নিন। অতিরিক্ত আলো ত্বক পুড়িয়ে দিতে পারে।
সানবাথ নিয়ে সহ্য করতে পারছেন কিনা তা আগে বুঝতে হয় কারোর দেখাদেখি একাজ কখনো নয়। সবটাই ত্বক চিকিৎসকের নজরদারি তে চলবে। প্রয়োজনীয় সতর্কতা মেনে নিলে, সূর্য স্নান মানুষের কাছে আজও আশীর্বাদ স্বরূপ। দুনিয়ার জুড়ে মানুষ সূর্যালোকের উপর নির্ভরশীল থাকে প্রতি মুহূর্ত।
Be First to Comment