চিত্রন চৌধুরী: কলকাতা, ২৭ এপ্রিল ২০২০ ।একটি কথা বলি। লকডাউনের দিন গুলো আমরা “হোয়াটস্যাপ”, “ফেসবুক”, “ইউটিউব”, “নেটব্যাঙ্কিং”, “এ.টি.এম”, “গুগল সার্চ”, “অনলাইন” খবর, “অনলাইন” স্কুলের ক্লাস, “মেডিক্যাল সফটওয়্যার সাপোর্ট”, “একাউন্টিং সফটওয়্যার” এবং সর্বোপরি “ইন্টারনেট” এবং “স্মার্ট ফোনের অ্যাপ্লিকেশনস” গুলো ছাড়া কল্পনা করতে পারতাম তো ? আরও অনেক আছে। তালিকাটা ভীষণই দীর্ঘ। বিগত এক মাসে এগুলি ব্যবহার করতে গিয়ে ভীষণ রকম সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন কি ? হয়তো নয়। এর নেপথ্যে থাকা কিছু কারণ মনে হয় জানা বা বলা দরকার। একটি বিশাল শ্রেণীর মানুষের অনেক অবদান আছে এর পেছনে। সারাদিন ঘরের দরজা বন্ধ করে, প্রতিনিয়ত ঘাড় গুঁজে কাজ উদ্ধার করা অনেক মানুষের জীবন কিন্তু পাল্টে দিয়েছে এই লক ডাউন। বাড়িতে রোজকার আসা পরিচারিকার অনুপস্থিতিতে সমগ্র সংসার, সন্তান, এমনকি বৃদ্ধ বাবা মা কে অবজ্ঞা করে সারাদিন বদ্ধ ঘরে বসে সব পরিষেবা চালু রাখা কিন্তু সহজ ব্যাপার নয় ! ইচ্ছে মতন সকালে উঠে বাড়ির নিত্য প্রয়োজনীয় কোনো জিনিস কিনতে বের হয়ে যাবো বললেই হলো না।
অপেক্ষা করতে হবে রবিবার বা ছুটির দিন আসার জন্য। অনেক অভাগার কপালে হয়তো রবিবারও আসেনা হিসেবে মতন ! বর্তমানে প্রতক্ষ করলাম বৃদ্ধ বাবার “হার্ট”-এর ডাক্তার হসপিটালে আসতেই পারছেন না। বাচ্চাদের ডাক্তারবাবুরাও বসতে পারছেন না। এই সময়ে এর মধ্যে অস্বাভাবিক কিছু নেই। কিন্তু ডাক্তারবাবু, পুলিশ, আর সামান্য কিছু সরকারি চাকুরীজীবি সামান্য জনাকয়েক ভাগ্যবানের কথা ছাড়া, আর কারও ব্যাপারে নিউজপ্রিন্ট খরচা হতে চোখে পরেনি বড় একটা। ডাক্তারবাবু বা পুলিশের বলিষ্ঠ ব্যাক্তিত্বের মানুষদের প্রত্যক্ষ অবদান ছাড়া সমাজ চলাই সম্ভব নয়, এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তাই বলে একটি বৃহৎ শ্রেণীর অবদান সম্পূর্ণ অস্বীকার করাটাও কিন্তু একটু হলেও সামাজিক দায়বদ্ধতার পরিপন্থী। এক শ্রেণীর শিক্ষক/শিক্ষিকাও কিন্তু রোজ সব কিছু ভুলে অনলাইন ক্লাস নিয়ে চলেছেন, নিজের সংসার সারাদিন বঞ্চিত করে।
লেখা ছাপা যাবেনা জেনেও ঘর বন্দি লেখকেরা লিখে চলেছেন প্রচার বা রোজকারের আশা না করেই। চাষী ভাইরা চাষ করছে বলেই খেতে পারছি, তারপর মুটে ভাইরা বয়ে নিয়ে যাচ্ছে বলে গুদামে গুদামে সামগ্রী পৌঁছে যাচ্ছে। তাদের এই অবদান নিশ্চই শ্রদ্ধার দাবি রাখে, সবই খবরের কাগজ খুলে দেখতেও পারছি। শুধু দেখতে পাচ্ছিনা, এর পরের পদক্ষেপে কিভাবে সাপ্লাই চেইন হয়ে “GST” সহ সব জটিল অংক কষে, তথ্য প্রযুক্তির সাহায্যে তা ঘরে ঘরে পৌঁছে যাচ্ছে !
ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি – যে সমাজের ধারণা – মূলত ডাক্তারবাবু আর পুলিশ ছাড়া সমাজের বাকি শ্রেনিদের কোনো ব্যাপারেই অবদান নেই, সেই সমাজের কিন্তু সবাইকে নিয়ে সামনে এগিয়ে চলাই মুশকিল হয়। তার সঙ্গেই তৈরী হয় একটা সামাজিক দূরত্ব।
ভালো এবং তার সঙ্গে কিছু খারাপ কিন্তু সব পেশাতেই, সব ধর্মেই আছে। আমার লেখার উদেশ্য কিন্তু কোনো পেশা বা ব্যক্তি বিশেষের সমালোচনা করা নয়। লেখার উদেশ্য, সমাজের চোখে দেখা এই পেশাদারি অসামঞ্জস্যতা।
বিগত এক মাসে তথ্য প্রযুক্তি সংস্থার দুজন উজ্জ্বল বৃত্তির উচ্চপদস্থ মানুষের কিন্তু অনলাইন কথোপকথনের সময়ই জীবনাবসান হয়েছে বিরামহীন এবং পাহাড়প্রমাণ কর্ম চাপের ফলে।
আজকের যুগে নিজেকে বা নিজের গোষ্ঠীকে প্রচারের মোড়োকে বিক্রি করাটাও কিন্তু একটি শিল্প ! সমাজের অনেক উজ্জ্বল তথ্যপ্রযুক্তি ব্যক্তির হাতে কিন্তু প্রচারের হাতিয়ারের অভাব ছিল না। কিন্তু তারা সেটি না করে, পেশদারী দক্ষতায় যেভাবে পৃথিবী চালিয়ে যাচ্ছেন তার জন্য আমি অন্তত গর্বিত। সমাজের এই ধরণের একটা বড় শ্রেণীর করদাতারা কিন্তু কোনো রকম সামাজিক স্বীকৃতি বা “মিডিয়া” অনুকম্পা ছাড়াই প্রতিনিয়ত নিজের নিজের দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। মনে হয় ভাবার সময় এসেছে। নাহলে আপনার ছেলে মেয়েও কিন্তু কৃতি ইঞ্জিনিয়ার হওয়া থেকে স্বেচ্ছায় বিরত থাকবে এর পরে ! তখন আবার অদূর ভবিষ্যতে সংখ্যাগতভাবে পেশাদারি অস্যমঞ্জস্যের সম্মুখীন হবে না তো আমাদের সমাজ ? নেহাত কলম হাতে আছে বলে কিঞ্চিৎ “অপ্রয়োজনীয়” কথা বলার সামান্য সুযোগ পেলাম। সব পেশার প্রতিই আমার সমান শ্রদ্ধা আছে। শুধুমাত্র পেশাগত পক্ষপাতিত্বই কেবল যা অনুপস্থিত। নচিকেতার গানের উল্টো গান গেয়ে প্রতিবাদ করাটা অবশ্যই ব্যাক্তি স্বাধীনতার মধ্যে পরে, এর নিশ্চই হয়তো বা প্রয়োজনও আছে। কিন্তু প্রচারের একটি অন্য দিক হলো আমার মতন সাধারণ মানুষদের প্রত্যাশার মাত্রাটাও বাড়িয়ে দেওয়া। যেমন আমি আশা করবো, করোনা ব্যাতিত অন্য মরণ রোগ গুলোর জন্য আমি কোনো একজনকে “OPD” তে ঠিক পেয়ে যাবো। এই অবস্থায় সেটা সম্ভব নয় জেনেও প্রত্যাশাটা কিন্তু ঠিক মনের কোণে উঁকি দেবে চারিদিকের লেখালেখি দেখে। আজকের যুগে করোনা সংশ্লিষ্ট কোনো গবেষণার মূল কারিগর নিশ্চই বিজ্ঞানী এবং ডাক্তারবাবুরা।
কিন্তু এখনকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং সর্বোপরি তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর “ডাটা” বিশ্লেষণ ছাড়া বর্তমানে এই গবেষণা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে তো ? কোনো প্রযুক্তি কর্মী হঠাৎ করে আক্রান্ত হলে সেই কর্মীর বা সেই কর্মীরই সংস্থার তৈরী তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর পুলিশের অন্যান্য পরিকাঠামো আছে তো তাকে সময় মতন গিয়ে উদ্ধার করে প্রাণ বাঁচাবার ? হয়তো বা সবই সম্ভব ! তবুও পারস্পরিক পেশাগত শ্রদ্ধা বাড়িয়ে, সামাজিক পেশাগত দূরত্ব যতদূর সম্ভব কমিয়ে নিয়ে আসাটাই ব্যাক্তিগত ভাবে আমার মনে হয় একান্ত কাম্য এই দুঃসময়ে। আমার পর্যবেক্ষন যদি ভুল হয় তাহলে আমি শুধু আনন্দিতই হবোনা , পরম নিশ্চিন্তও বোধ করবো।
Be First to Comment