———————স্মরণ : ব্রজেন দাস—————
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, অলস বলে বেশ দুর্নাম আছে বাঙালি জাতির। আমরা পরিশ্রম করতে চাই না। স্বভাবে অতিরিক্ত আরামপ্রিয়। কিংবা অল্পতেই তুষ্ট হবার অভ্যাস আছে আমাদের। কিন্ত আমাদেরই কিছু পূর্বপুরুষ সামর্থ্যের সীমা ভেঙেছিলেন– দেখিয়ে দিয়েছিলেন বাঙালির রক্তে কত তেজ, সে তেজের বলে বলীয়ান হয়ে বাঙালি পাড়ি দিতে পারে সাগর- মহাসাগর। অবাধ্য জেদ চেপে বসলে মৃত্যুভয়কে তুচ্ছ করে বীর বাঙালি নতুন কীর্তিগাঁথা রচনা করে সারাবিশ্বে ফেলে দিতে পারে হইচই, জন্ম দিতে পারে নতুন ইতিহাসের! তেমনই এক বীর বাঙালি ছিলেন ব্রজেন দাস। কি করেছিলেন ব্রজেন দাস? কেন তার এই কীর্তি নিয়ে ছয় দশক পরেও এত আলোচনা? ব্রজেন দাস সাঁতরেছিলেন। সাঁতার কেটে পার করেছেন ইংলিশ চ্যানেল। তাও এক দুইবার নয়, ছয় ছয়বার! উপমহাদেশের প্রথম সাঁতারু হিসেবে অনন্য এই কীর্তি গড়েছিলেন ব্রজেন দাস। ব্রজেন দাস ১৯২৭ সালের ৯ ডিসেম্বর মুন্সীগঞ্জের বিক্রমপুরে জন্মগ্রহণ করেন। নদীমাতৃক এই অঞ্চলের মানুষজন সাঁতার ভালোবাসবে, এটাই স্বাভাবিক। ছোটবেলা থেকেই বুড়িগঙ্গার বুকে লাফ-ঝাঁপ দিয়েই শৈশব-কৈশরের সোনালি দিনগুলো কাটিয়েছেন ব্রজেনবাবু।
ঢাকার কে এল জুবিলি হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করে ব্রজেন দাস পড়তে গেলেন কলকাতা। তখনও ভারত ভাগ হয়নি। কলকাতার বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট আর বি.এ পাশ করেছিলেন ব্রজেন দাস, সাঁতারের সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্কটা তখন থেকেই জোরালো হয়। কৈশোরের শখটাকে তিনি পরিণত করেছিলেন নেশায়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের সাঁতার ফেডারেশন গঠিত হয়েছিল, সেটার সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়েছিল লাহোরে। অথচ পশ্চিম পাকিস্তানে নদী কয়টা আছে সেটা হাতের আঙুল গুণেও বের করা যাবে। পূর্ববঙ্গে এত নদী, এত সাঁতারু, অথচ জাতীয় ফেডারেশনের নির্বাহী কমিটিতে স্থান দেয়া হয়নি কোন বাঙালিকেই!বঞ্চনার শেষ এখানেই নয়। ১৯৫৪ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল ন্যাশনাল অলিম্পিক, ১০০ মিটার ফ্রি-স্টাইল সাঁতারে প্রথম হলেন ব্রজেন দাস। তিনি ততদিনে সাঁতারকে নেশা আর পেশা হিসেবে গ্রহণ করেছেন। কিন্ত তার এই বিজয় মানতে পারেনি পাকিস্তানী বিচারকেরা। মনগড়া কারণ দেখিয়ে অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছিল ব্রজেন দাসকে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঘা বাঘা অফিসারদের হারিয়ে সবার আগে সাঁতার শেষ করেছিলেন ব্রজেন। একজন ‘নীচুজাতের বাঙাল’-এর এমন সাফল্যে আঁতে ঘা লেগেছিল ওদের। সেকারণেই ব্রজেনকে ডিসকোয়ালিফাইড করেছিল বিচারকেরা। কিন্ত পরেরদিনের খবরের কাগজে এই অনিয়মের প্রতিবাদ করা হয় তীব্রভাবে। ফলশ্রুতিতে বিচারকেরা আবার ইভেন্টের আয়োজন করতে বাধ্য হল, সেখানে আরও একবার বাকীদের পেছনে ফেলে চ্যাম্পিয়ন হলেন ব্রজেন দাস। পরের বছর পাকিস্তান অলিম্পিকেও ১০০ আর ৪০০ মিটারে চ্যাম্পিয়নের নাম ব্রজেন দাস। এই টুর্নামেন্টের চ্যাম্পিয়নরাই ১৯৫৬ সালের মেলবোর্ন অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পাবেন, নিয়ম ছিল এটাই। কিন্ত ব্রজেন দাস বাঙালি হওয়ায় তার বেলায় পাল্টে গেল নিয়মটা! অস্ট্রেলিয়ায় পাকিস্তানের দলে পাঠানো হল এমন প্রতিযোগীদের, যাদের পেছনে ফেলে জিতেছিলেন ব্রজেন দাস।
পুরো পাকিস্তানে সাঁতার জগতে তিনি তখন অবিসংবাদিত সেরা। সেই সেরা খেলোয়াড়টিকে শুধুমাত্র জাতিগত বৈষম্যের কারণে বাদ পড়তে হয়েছিল বিশ্বের সবচেয়ে বড় ক্রীড়া আসরে অংশগ্রহণের সুযোগ থেকে। একদিন সকালে রোজকার মতো খবরের কাগজ পড়তে গিয়েই একটা জায়গায় চোখ আটকে গেল তাঁর। কয়েকবার পড়লেন তিনি খবরটা। কোন এক সাঁতারু পরপর চারবার প্রচেষ্টা চালিয়েও ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রম করতে ব্যর্থ হয়েছেন। ইংলিশ চ্যানেল জিনিসটা কি সেটা তখনও জানেন না ব্রজেন দাস, কিন্ত মাথায় ভূত চাপলো, অন্যেরা যেটা পারছে না সেটাই করে দেখাবেন তিনি। তখনই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন, যেভাবেই হোক, ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে হবেই ! খোঁজখবর শুরু করলেন তিনি। শরণাপন্ন হলেন ক্রীড়াঙ্গনে তার পরিচিত জনদের। তার মনের কথা শুনেই আঁতকে উঠলেন সবাই। এই লোকে বলে কি! যেটা আজ পর্যন্ত ভূ-ভারতের কেউ করতে পারেনি, সেটা করার কথা ভাবছে সে! ১৯৫৮ সালের ৮ আগস্ট। রাত পৌনে দুইটা। গভীর অন্ধকার চারদিকে, দুই হাত দূরের জিনিসও দেখা যায় না, এমন অবস্থা। কুয়াশার আবরণে ঢাকা চারদিক, হিমেল বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকা দায়। জল কনকনে ঠান্ডা, ঢেউয়ের তীব্রতাও স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকখানি বেশি। শনশন শীতল বাতাসে কেমন একটা অদ্ভুত রহস্যের গন্ধ। ব্রজেন দাস দাঁড়িয়ে আছেন তীরে, পাশে আরও জনা চল্লিশেক সাঁতারু; তেইশটি পৃথক দেশ থেকে ওরাও এসেছেন সাঁতার কেটে ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিতে। সামনে গভীর অন্ধকারে ঢাকা সাগরপথ, পাড়ি দিতে হবে একুশ মাইল লম্বা দূরত্ব! ব্রজেন দাস ঢাকা-চাঁদপুর নদীপথে পাড়ি দিয়েছেন বেশ ক’বার। কিন্তু সেসবের সঙ্গে ইংলিশ চ্যানেলের তুলনা চলে না। কোন অভিজ্ঞতা নেই, লোকের মুখে শোনা কথাকে সম্বল করে ঝাঁপ দিয়েছেন তিনি অথৈ সাগরে। পাশ দিয়েই চলছে চ্যানেল কমিটির পর্যবেক্ষক দলের বোট। হিমশীতল ঠাণ্ডায় শরীর জমে আসে ব্রজেন দাসের, হাত-পা নাড়াতে কষ্ট হয় প্রচণ্ড। ব্রজেন দাস হার মানেননি। তেরো ঘন্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট পরে পায়ের নীচে মাটির অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন ব্রজেন দাস। এর আগে কোন এশিয়ান মানব এই কাজটা করে দেখাতে পারেননি, যেটা করেছেন ব্রজেন দাস!
এরপরেও ব্রজেন দাস ইংলিশ চ্যানেল পাড়ি দিয়েছেন, একবার দুবার নয়, পাক্কা ছয়বার। সেই আমলে সংখ্যার বিচারে সবচেয়ে বেশিবার ইংলিশ চ্যানেল পার করেছিলেন তিনিই। এরমধ্যে একবার পুরোটা পথ পেরিয়েছিলেন মাত্র দশ ঘন্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট সময়ে; সেই সময়ের রেকর্ড ছিল সেটা। অজস্র সম্মাননা আর পুরস্কারে ভূষিত করা হয়েছিল তাকে।
ব্রজেন দাস শুধুমাত্র ইংলিশ চ্যানেলজয়ী সাঁতারু নন, তিনি বাঙালির সাহসিকতার প্রতীক।
ব্রজেন দাস ১৯৯৮ সালের আজকের দিনে (১ জুন) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment