———-জন্মদিনের শ্রদ্ধাঃ সুচিত্রা সেন———
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, ছাব্বিশ বছরের চলচ্চিত্র জীবন আর প্রায় সাড়ে তিন দশকের স্বেচ্ছা নির্বাসন যুক্ত করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়ায় তার পুরোটাই কিন্তু সুচিত্রার একটানা জনপ্রিয়তা। এমন প্রবল জনপ্রিয়তা সিনেমার কড়চায় আছে কিনা সেটাও জিজ্ঞাসাচিহ্ন হয়ে ঝুলে রইলো। সুচিত্রা সেন নামের পরতে পরতে জড়ানো অপার এক রোমান্টিক রহস্য। রহস্য তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসনকে ঘিরেও। ১৯৫২ সালে ‘শেষ কোথায়’ নামে এক অমুক্তিপ্রাপ্ত ছবির মাধ্যমে যাঁর চলচ্চিত্রের আঙিনায় প্রবেশ সেই তিনিই ১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ ছবি মুক্তির পর চলে গেলেন আড়ালে। সে ‘আড়াল’ কি কোনো অভিমানের? জবাব কোনোদিনও স্পষ্ট হয়নি। এক সময় এমন আড়ালকে বেছে নিয়েছিলেন অভিনেত্রী গ্রেটা গার্বো। হলিউড কাঁপানো গ্রেটা গার্বোর সঙ্গে তুলনাটা নেহাতই শিশুসুলভ হবে— তবে একথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, স্বেচ্ছায় আড়ালে গিয়ে মগ্ন থাকার মুহূর্তগুলি সুচিত্রা যেভাবে একা উপলব্ধি করেছেন তার উদাহরণ বিশ্ব চলচ্চিত্রে নজিরবিহীন।
আটাত্তরের ‘প্রণয় পাশা’ সে অর্থে বাণিজ্যিক অঙ্ক ছুঁতে পারেনি। তবু বাঙালি দর্শকের মনে ‘সুচিত্রা’ চিহ্ন অন্যভাবেই গাঁথা হয়ে গিয়েছে। বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়ির সামনে আটের দশকের শেষ থেকে চলেছে অলসহীন অপেক্ষা— সংবাদমাধ্যমের। যদি তিনি একবার কিঞ্চিৎ কিছু বলেন। যদি ডাকেন, তাঁর স্বেচ্ছা আড়াল সম্পর্কে কিছু বলার জন্য। অনন্ত অপেক্ষা প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। তিনি আড়াল থেকে আরো গভীর অন্দরমহলে একা। এতোই যে ২০০৫-এ ‘দাদাসাহেব ফালকে’ সম্মানও নিতে রাজি হননি, অন্তরাল ভাঙতে হবে বলে। সাধারণ ঘরের কন্যা রমা। জন্ম পাবনায়। বাবা ছিলেন স্কুল শিক্ষক। অনেকগুলি ভাইবোন। মামাবাড়ির আদুরে নাম ছিল কৃষ্ণা। টালিগঞ্জে এসেই নামবদল ‘সুচিত্রা’। প্রথম মুক্তি পাওয়া ছবি ‘সাত নম্বর কয়েদি’। পরিচালক ছিলেন সুকুমার দাশগুপ্ত। তাঁর সহকারী পরিচালক নীতিশ রায়ই একদিন রমা’র নাম বদলে রাখলেন ‘সুচিত্রা’। নামকরণের সময় নীতিশ রায়ও ভাবতে পারেননি একদিন ওই নামটাই বাঙালির আধুনিক রোমান্টিকতার সমার্থক হয়ে দাঁড়াবে। গ্রেটা গার্বো, মেরিলিন মনরো বা সোফিয়া লোরেন এককালে শিক্ষিত বাঙালি দর্শকের মনে আলোড়ন তুলেছিলেন।
রূপালি পর্দায় ওঁদের হাঁটাচলা, চোখের চাউনি, অভিব্যক্তি অনেককেই মাতিয়েছে। পাঁচের দশকের মধ্যে সময়টা চিহ্নিত করলে সুচিত্রার কাছে সেটা ছিল চরম পরীক্ষা। অগ্নি পরীক্ষাই বটে। ১৯৫৪ সালে নতুন ছবি ‘অগ্নিপরীক্ষা’য় সসম্মানে উতরে গেলেন। নতুন এক অভিব্যক্তি নিয়ে সুচিত্রা হাজির বড় পর্দায়। ১৯৫৪ সালের ‘অগ্নিপরীক্ষা’। ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’—সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে লিপ দিচ্ছেন সুচিত্রা। তখনও তো তিনি নতুন প্রায়। মনে রাখার মতো তেমন দৃশ্য তো খণ্ড খণ্ড। তবুও সেই অনিন্দ্য মুখশ্রী আর লাবণ্য ঘেরা চোখের চাউনি সূচনা করেছিল বাংলা ছবির এক নয়া যুগের। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়া ‘শাপমোচন’, ‘মেজবউ’ কিংবা ‘সবার উপরে’ ছবিতে উত্তমকুমারের পাশেই যার অবস্থান সেই সুচিত্রা কিন্তু কোনভাবেই তাঁর আগের কোন অভিনেত্রীর দ্বারা প্রভাবিত হননি। নিজস্ব স্টাইলটা রপ্ত করেছিলেন অভিনয়ের প্রতি নিষ্ঠা, ধৈর্য আর সাহস নিয়ে। সুচিত্রা জানতেন কীভাবে চরিত্রের মধ্যে আত্মস্থ হতে হয়। ১৯৫৫-তে তাঁর প্রথম হিন্দি ছবি ‘দেবদাস’-র জন্য পান সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার। অভিনয় করেছিলেন ‘পারো’র চরিত্রে। ‘সাত পাকে বাঁধা’-র জন্য মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা অভিনেত্রীর পুরস্কার। ১৯৭৪-এ ‘আঁধি’-তেও অসামান্য অভিনয় করেছিলেন এক রাজনৈতিক নেত্রীর ভূমিকায়।
‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই শিকোয়া তো নেহি’ ভেসে বেড়িয়েছে বহু বছর। কিন্তু তিন-চার বছর পরে তারপরে আর চলচ্চিত্রের জগতে থাকতে চাইলেন না। সুচিত্রা সেন গায়িকা হতে চেয়েছিলেন, হয়েছিলেন নায়িকা। তবে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠ এবং সুচিত্রা সেনের অভিনয় মিশে গিয়েছিল সেরা সমন্বয়ে। সেই সোনা-ঝরানো গানগুলি ছাড়া সম্ভবত তিনিও হয়ে উঠতে পারতেন না বাঙালির চিরকালের ‘ম্যাটিনি আইডল’।
মহানায়িকা সুচিত্রা সেন ১৯৩১ সালের আজকের দিনে (৬ এপ্রিল) পাবনায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment