Press "Enter" to skip to content

ফাঁসি কি একমাত্র সমস্যার সমাধান করতে পারে?

Spread the love

ফাঁসিই কি সমস্যার সমাধান? পর্ব ৩সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: ২২শে জানুয়ারি ২০২০ নির্ভয়া কাণ্ডের চার অপরাধীকে তিহার জেলের যে সেলে ফাঁসির মঞ্চ আছে তার কাছাকাছি চারটি পৃথক সেলে এনে রাখা হয়েছে। পুষ্টিকর খাদ্য বাড়ানো হয়েছে। হচ্ছে নিয়মিত ডাক্তারি পরীক্ষা।সরকারি সূত্রের খবর, নিয়মিত হাঁটাচলা, ব্যায়াম এর জন্য চার বন্দীকে যখন সেলের বাইরে আনা হচ্ছে তারা নিজেদের মধ্যে ফাঁসি কী করে আইনি প্যাঁচে পিছানো যায় তার শলাপরামর্শ করছে। আসন্ন মৃত্যু নিয়ে তেমন হেলদোল নেই। মনোবিদদের বক্তব্য, অপরাধীদের মানসিকতার ক্ষেত্রে আসন্ন মৃত্যুর প্রতিক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন হয়। কেউ কেউ ভীত হয়ে আগ্রাসী হয়ে ওঠে। কারও কারও কোনো তাপ উত্তাপ দেখা যায় না। নিজের অপরাধ সম্পর্কে অনুশোচনা ও হয় না। ইংরেজ শাসনে বন্দী বিপ্লবীরা ছিল অপরাধী। তাঁরা আদর্শের জন্য ফাঁসি কাঠে হাসতে হাসতে প্রাণ দিয়েছেন। সেক্ষেত্রেও জীবন মৃত্যু তাঁরা এক নজরে দেখেছেন। অপরাধীদের ক্ষেত্রে মনস্ত্বতের এক গবেষণা চলছে। এব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে আমেরিকার শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা। গবেষকদলের প্রধান সাইমন ল্যাক্স বলেছেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানবদেহের অণুজীবগুলির বৈশিষ্ট্য বদলে যাচ্ছে কিনা এবং মানুষ নিকট অতীতে কোন কোন এলাকায় চলাফেরা করেছে পর্যবেক্ষণ করার জন্য দুজনের গতিবিধি নজরে রাখা হয়। তাদের মোবাইল ফোন, জুতো, চশমা, ঘড়ি, হেঁটে যাওয়া রাস্তা,সিঁড়ি, লিফট, মেঝে দুদিন ধরে ঘণ্টা দুয়েক পর্যবেক্ষণ করা হয়। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা ব্যাকটেরিয়া শনাক্ত করেছেন। অপরাধীদের শরীরের ব্যাকটেরিয়ার সঙ্গে কতটা মিল দেখেও আগামীদিনে অপরাধী চিহ্নিত করা যেমন সহজ হবে তেমন অপরাধীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও আইনের চোখে ধরা পড়বে। ফিরে আসা যাক মূল প্রসঙ্গে। আর কোনো আইনি জটিলতা দেখা না দিলে নির্ভয়া কাণ্ডের চার অপরাধীর ১ ফেব্রুয়ারি সকাল ছ়টায় ফাঁসি হয়ে যাবে। মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে তৈরি ফাঁসুড়ে পবন জল্লাদ। তার বক্তব্য, ওদের ফাঁসি হওয়াই উচিত। ওরা যে অন্যায় করেছে তার উপযুক্ত শাস্তি ফাঁসি। সে জানিয়েছে, ফাঁসির পর দেহ ততক্ষণ ঝুলিয়ে রাখা হয় যতক্ষণ না ডাক্তারবাবু মৃত বলে ঘোষণা করছেন ।ফাঁসি নিয়ে চমকপ্রদ ঘটনাও আছে। প্রায় চারশো বছর আগে লন্ডনে ধর্ষণ ও খুনের মামলাতে উইলিয়াম ডুয়েল নামে একজনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। পরে হাসপাতালে টেবিলে শুইয়ে পরীক্ষা করার সময় ডাক্তাররা দেখেন ফাঁসির আসামী শ্বাস নিচ্ছেন। দুঘন্টা পর সে টেবিলে উঠে বসে। পরে তাকে যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর দেওয়া হয়। ১৮০৩ সালে ডাকাতি ও খুনের দায়ে জোসেফ স্যামিউয়েলের ফাঁসি হয়। আশ্চর্য্যের ব্যাপার ফাঁসি দিতে তার গলায় যতবার দড়ির ফাঁস পড়ানো হয় ততবার ফাঁস ঢিলে হয়ে যায়। ঘটনাটি অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে ঘটে। সিডনির গভর্নর জেনারেল বিষয়টি জেনে মনে করেন, প্রভু যিশু চাইছেন না। শেষপর্যন্ত সেই অপরাধীর আজীবন কারাবাস হয়। ফাঁসি নিয়ে নানা মত। কেউ বলেন জঘন্য অপরাধের শাস্তি ফাঁসি। কেউ বলেন আরও নৃশংস উপায়ে মৃত্যু। কেউ বলেন, না,আধুনিক যুগে বিষ ইনজেকশন বা বৈদ্যুতিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা উচিত। কেউ বলেন ,না, মৃত্যুদণ্ড দিলে তো হয়েই গেলো। সে যেমন কষ্ট দিয়ে ধর্ষণ বা হত্যা করেছে, সেই অপরাধীকেও উচিত সারা জীবন কষ্ট দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা। যাতে সে প্রতি মুহূর্তে যন্ত্রণার জ্বালা উপলব্ধি করতে পারে। আবার কিছু সংবেদনশীল মানুষ ফাঁসির বিরুদ্ধে। তাঁরা মনে করেন ফাঁসি সমস্যার সমাধান নয়। মনস্ত্বত্তবিদরা বলেন, মানুষ কেন অপরাধ করে তার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা দেওয়া এখনই সম্ভব নয়। তবে সাধারণ মানুষ আর অপরাধীর ব্যক্তিত্ব আলাদা। সপ্তদশ শতকের আগে ধারণা ছিল শরীরে দুষ্ট আত্মা ভর করার জন্য মানুষ অপরাধ করে। এটাও ঠিক ৭০ শতাংশ অপরাধী অপরাধ করে পরিস্থিতির শিকার হয়ে।৯০ শতাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে অপরাধীদের শৈশবের কোনও নেতিবাচক স্মৃতি মনে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করে। নব্বই এর দশকে বিজ্ঞানীরা দুই যমজ কে নিয়ে পরীক্ষা করেন দুই পরিবেশে রেখে। বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে মস্তিষ্কে অ্যাড্রেনালিন, নর অ্যাড্রেনালিন ডোপামিনের পরিমাণ বেড়ে গেলে বা সেবোটনিন বি ডি এল এফ ইত্যাদির পরিমাণ কমে গেলে অপরাধ প্রবণতা দেখা দেয়।বিজ্ঞানীরা এও বলেন, জিনগত বা বংশগত প্রভাব বলতে যা বোঝায় তা আপাত দৃষ্টিতে এক মনে হলেও বিষয় দুটি আলাদা।কেননা কোন মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য কেমন হবে তা দেহের কোষের ডি এন এর কিছু জিনের ওপর যেমন নির্ভর করে তেমন দুজন অপরিচিত মানুষের জিনগত মিল থাকে ৯৯.৫ শতাংশ। সুতরাং বংশগত কিছু অসুখ বিসুখ থাকলেও অপরাধপ্রবণতা থাকাটা বিজ্ঞানসম্মতভাবে সঠিক নয়।জঘন্যতম অপরাধের ক্ষেত্রে ফাঁসি অপরাধ কমাবে এমন একটি রিপোর্ট ১৯৬৭ সালে ভারতের আইন কমিশনের ৩৫ তম রিপোর্টে বলা হয়। পাশাপাশি একথাও স্বীকার করা হয় সেই রিপোর্টে যে বিষয়টি নিয়ে নানা দেশের মধ্যে মতবিরোধ আছে। ২০১৫সালে সেই আইন কমিশনের রিপোর্ট বিপরীত কথা বলেছে।(রিপোর্ট নং ২৬২) তে বিচারপতি এ পি শাহের নেতৃত্বাধীন আইন কমিশন বলেছে,বহু গবেষণা,পরিসংখ্যান অনুধাবন করে বলা যায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের চেয়ে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ সমাজে অতিরিক্ত কোনও সুফল দেয় না। রাষ্টপুঞ্জও মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে প্রস্তাব নিয়ে জানিয়েছে, ফাঁসি বা মৃত্যুদণ্ড অপরাধ কমায়এটা স্রেফ গপ্পো। সুতরাং সন্ত্রাসবাদী ছাড়া কাউকে ফাঁসি দেওয়া বন্ধ করা উচিত। ভারত এই ক্ষেত্রে দোলাচলে থেকেছে। রাষ্ট্রসংঘের সুপারিশ গ্রহণওকরেনি, বর্জন করে নি। ২০০৪ সালে ধনঞ্জয় এর ফাঁসির পর দীর্ঘ আট বছর কোনও ফাঁসি হয়নি। তারপর আজমল কাসভ, আফজল গুরু ও ইয়াকুব মেননকে ২০১২ থেকে ২০১৫ সাল সময়ে ফাঁসি দেওয়া হয়।২০১২ তে নির্ভয়া কাণ্ডের পর প্রবল প্রতিবাদের প্রতিক্রিয়ার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার নতুন আইন প্রণয়নের জন্য বিচারপতি জে এস বর্মার নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের কমিটি নির্মাণ করে। সেই কমিশন কিন্তু ধর্ষণ এর শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দেবীকে নেতিবাচক আখ্যা দিয়ে বলে সভ্য সমাজে মৃত্যু সমাজকে পিছিয়ে দেবে। এতে ধর্ষণের অপরাধ কমবে ধারণাটি ভূল। প্রবল চাপ থাকলেও বর্মা কমিশন নিজেদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে। কমিশন আমৃত্যু কারাবাসের পক্ষে রায় দেয়। প্রশাসনের জনগণের চাপকে যুক্তি হিসেবে খাড়া করার তীব্র সমালোচনাও করে।প্রশাসনের উচিত সুস্থ জনমত গড়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা নেওয়া। কিন্তু জনপ্রিয়তা ভোটের স্বার্থে রক্ষা করার প্রবণতাই প্রশাসনকে ফাঁসি প্রথা বহাল রাখতে উৎসুক করেছে।(চলবে)পর্ব-৪ আগামীকাল

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.