————————–পর্ব -২————————-
সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা ২০শে জানুয়ারি ২০২০ প্রথম পর্ব শেষ করেছিলাম যিশুর বাণী দিয়ে। তিনি বলেছিলেন,পাপ কে ঘৃণা করো, পাপীকে নয়। ইউরোপের দেশগুলি খ্রিস্টান মতের পথিক হলেও অপরাধের বিচারে পাপকে ঘৃণা করার সঙ্গে সঙ্গে পাপীকেও ঘৃণা করার নিদান দেন। অনেকেই বলবেন যুগের বিবর্তনের সঙ্গে বিশ্বের নীয়ম নীতি বদলাতে হয়। তাই আইনে শাস্তির বিধান। কিন্তু এটাও মানতে হবে ইদানিং শাস্তির দৃষ্টিভঙ্গি উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পাল্টাচ্ছে। সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে আনতে অপরাধীদের জেল সংশোধনাগার হিসেবে কাঠামো বদল করা হচ্ছে। কিন্তু সব ধর্মেই যে মানব প্রেমের বাণী উচ্চারিত হয়েছে তা নয়। যেমন ক্যাথলিক খ্রিস্টান ধর্মে যা আমরা ওল্ড টেস্টামেন্ট হিসেবে জানি সেখানে আদম ইভ এর একটি কাহিনী আছে। এই আদি মানব যুগলের দুই পুত্র ছিল অ্যাবেল ও কেইন। কৃষিজীবী বড়ভাই খুন করে ছোট ভাইকে।(জেনেসিস ৪:১-১৮)
ওল্ড টেস্টামেন্টে (২১:১২)- এ বলা হয়েছে , কাউকে হত্যা করা, অপহরণ করা(২১:১৬), ব্যভিচার করলে সমকামী হলে (লেবীয় ২০:১৩), ভন্ড নবী হলে (দ্বিতীয় বিবরণ ১৩:৫), পতিতাবৃত্তি এবং কাউকে ধর্ষণ করলে (দ্বিতীয় বিবরণ ২২:৪) এবং অন্যান্য মারাত্বক অপরাধ করলে মৃত্যুদণ্ডের বিধান দেওয়া হয়েছে। ওল্ড টেস্টামেন্টে পরিষ্কার বলা হয়েছে পাপের বেতন মৃত্যু। ঠিক বিপরীত কথা নিউ টেস্টামেন্টে যিশু বলেছেন পাপের শাস্তি তিনিই দিতে পারেন যিনি নিজে কোনো পাপ করেন নি।
জাপানে এখানকার অধিকাংশ মানুষ বৌদ্ধ ধর্মে আস্থা রাখেন। স্বয়ং বুদ্ধদেব তাঁর অনুগামীদের মধ্যে কেউ পাপ করলে তাঁকে সংঘ থেকে বহিস্কার করতেন না। তাদের মানসিক পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। সেখানেও ছিলেন বিদ্রোহী একদল ভিক্ষু। যাঁরা পাপের কঠোর শাস্তির পক্ষে ছিলেন ।কিন্তু বুদ্ধদেবের বিরুদ্ধে যাওয়ার সাহস ছিল না। তাঁর নির্বাণের পর বহু অনুগামী ভিক্ষু হাঁপ ছেড়ে বাঁচেন। সমীক্ষা বলছে জাপানে ৮০% মানুষ অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে।
ইসলাম ধর্ম প্রসঙ্গে আশা যাক। অনীশ সংস্কৃতি পরিষদ প্রকাশিত গিয়াসউদ্দিনের লেখা ‘নানা ঘটনায় ইসলাম ‘বইটির ১৩ পৃষ্ঠায় লেখক লিখেছেন,’……. শুধু বিধর্মী বা কাফেরদের প্রতি নয়,এটা ইসলাম ধর্মের একটি সাধারণ নীতিও বটে। কোরআনে সমান মাপের প্রতিশোধ (কিসাস) নেওয়ার সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে। তা হলো”আমি তওরাতে (আল্লার পূর্বের একটি গ্রন্থ)বিধান দিলাম যে জানের বদলে জান, চক্ষুর বদলে চক্ষু, নাকের বদলে নাক, কানের বদলে কান, দাঁতের বদলে দাঁত এবং জখমের বদলে অনুরূপ হইবে। কেহ ক্ষমা করিলে তাহারই পাপ মোচন হইবে ।”(৫.৪৫)।এখানে ক্ষমার কথা বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু জোর প্রদান করা হয়েছে কিসাসের (সমান মাপের প্রতিশোধ) ওপর। এইরূপ প্রতিশোধ প্রসঙ্গে কোরআন অন্য স্থানে বলছে,’ হে বিশ্বাসী লোক সকল, তোমাদের সম্বন্ধে হত ব্যক্তির বিনিময়ে হত্যা করা লিখিত হইয়াছে, স্বাধীন স্বাধীনের তুল্য, দাস দাসের তুল্য, নারী নারীর তুল্য, যে ব্যক্তি তাহার ভ্রাতার পক্ষ হইতে নিজের জন্য কিছু ক্ষমা প্রাপ্ত হইবে তৎপর বিধির অনুসরণ করিয়া তাহার চলা এবং সদ্ভাবে (হত্যার মূল্য) পরিশোধ করা (কর্তব্য), ইহা তোমাদের প্রতিপালকের নিকট হইতে লঘু করা হইল, অনন্তর ইহার পরে যে ব্যক্তি সীমা লঙ্ঘন করিবে তাহার জন্য দুঃখকর শাস্তি আছে।(২:১৭৮)।
এবার হিন্দু ধর্ম। মনুসংহিতায় (৮:৩২৩) বলা হয়েছে, নারী অপহরণকারীদের
মৃত্যুদণ্ডের কথা। মনুসংহিতা য় (৮:৩৫৩) আরও বলা হয়েছে, যারা নারী, শিশু ও গুণবান পণ্ডিতদের হত্যা করে, ধর্ষণ করে তাদের এমন শাস্তি দিতে হবে যেন অপরাধীদের মনে ভীতির সঞ্চার হয়। শুধু অপরাধী নয়, প্রত্যেক ধর্মেই বিধর্মীদের মৃত্যুর বিধান আছে। মুসলিম ধর্মে যেমন বিধর্মীদের মারার জন্য জিহাদের কথা বলা হয়েছে, খ্রিস্টান ধর্মে মুসলিমদের হত্যা হয়েছে ক্রুসেডের নামে, হিন্দু ধর্মেও জিহাদ হয়েছে। ঋক বেদের ১মন্ডল,১৩২ সুক্ত, শ্লোক ৬,(অনুবাদ রমেশ চন্দ্র দত্ত, পৃষ্ঠা ১৮৩)_এ বলা হয়ে ছে ,’ হে ইন্দ্র ও পর্যন্য! তোমরা দুজনে অগ্রগামী হয়ে যে শত্রু আমাদের বিরুদ্ধে সেনা সংগ্রহ করে তাদের সকলকেই বিনাশ করো ।’
সুতরাং ধারাবাহিক মানুষের চেতনাতে মারের বদলে মার, খুনের বদলে খুনের মানসিকতা তৈরি হয়ে আছে।
মহাত্মা গান্ধীর পৌত্র এবং বাংলার প্রাক্তন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধী একটি বই লিখেছেন ” অ্যাবলেশিং দ্য ডেথ পেনান্টি হোয়াই ইন্ডিয়া শ্যুড সে নো টু ক্যাপিটাল পানিশমেন্ট’। তিনি লিখেছেন , “…… এটাও তর্কাতীত নয় যে ভারত তত্ত্বগতভাবে মৃত্যুদণ্ড বিলোপ মনোভাব পোষণ করে। নানা ধরনের কঠোর আইনে মৃত্যুদণ্ড প্রধান সাজা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের অবস্থান দোলাচলের। ফাঁসি দাও এখনই/ফাঁসি দিও না এমন কোনো শাস্তি দানের নীতি নিধারিত নেই। ইংরেজিতে যাকে বলে sentencing policy. সমাজের বিবেক চাইছে তাই মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের এহেন নিদান নেহাতই আইন। যা সংবিধানগত নয়। (চলবে)
আগামীকাল পর্ব -৩
ফাঁসিই কি সমস্যার সমাধান?
More from GeneralMore posts in General »
- Minimally Invasive Robotic Surgery at Narayana Hospital RN Tagore Hospital, Mukundupur, Offers Life-Changing Results for Ureteric Stone Patient….
- H.E. Dr. C.V. Ananda Bose, Hon’ble Governor of West Bengal, Inaugurates the AIU East Zone Vice Chancellors Meet 2024-2025 with JIS University as the Host University….
- আদিবাসী শিশু কল্যাণ বিদ্যাপীঠের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগে এবার গোবরডাঙ্গা নকসা।
- কলকাতায় আইআইটি – জেইই এবং নিট কোচিংয়ে রাইস বানসাল এর নতুন উদ্যোগ…।
- নিউ দিল্লিতে কর্তব্য পথের নেতাজি মূর্তিতে লেফটেন্যান্ট পিল্লাইয়ের শ্রদ্ধা ও ভারতীয় সেনার সম্মান প্রদর্শন…..।
- এন্টোড কলকাতায় শিশু কিশোরদের শ্রবণ হ্রাস সমস্যার বৃদ্ধি মোকাবিলায় জাতীয় শ্রবণ সপ্তাহের আয়োজন করলো…।
Be First to Comment