———————– সমপর্ব -৪——– সুজিত চট্টোপাধ্যায়: কলকাতা, ২৪শে জানুয়ারি ২০২০ ভোট বড় বালাই। সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী ভোট বিভাজনে সংখ্যালঘু ভোট নিয়েও সরকার গঠন করা যায় । সুতরাং ধর্মভীরু দেশ ভারতের জনগণ যে মোটেই অপরাধীকে ক্ষমার চোখে দেখে না বরং খুনের বদলে খুনে বিশ্বাসী সেকথা ক্ষমতাসীন দল বুঝতে দেরি করে না।তাইতো বর্ষীয়ান আইনজীবী ইন্দিরা জয়সিং যখন নির্ভয়ার খুনিদের ক্ষমা করে দেওয়ার কথা বলেন তখন নির্ভয়ার মা আশা দেবী তীব্র আক্রমণ করেছিলেন আইনজীবী ইন্দিরাকে। এবার আর এক ধাপ এগিয়ে ইন্দিরাকে বাক্যবাণ ছুড়েছেন অভিনেত্রী কঙ্কনা রানাউত। তিনি বলেছেন অপরাধীদের সঙ্গে তাকে জেলে রাখা উচিত। এই মহিলারা অপরাধীদের সমব্যাথী হতে পারেন। এই ধরণের মহিলারাই এমন দানবের জন্ম দেন।
কঙ্গনা বরং ধর্ষকদের সর্বসমক্ষে ফাঁসিতে ঝোলানোর আর্জি জানিয়েছেন আদালতের কাছে। প্রসঙ্গত বলা যায়,আইনজীবী ইন্দিরার অনুরোধ মেনে যদি আশা দেবী চার খুনি ধর্ষকদের মাফ করেও দিতেন তাহলেও অপরাধীদের মুক্তি পাওয়ার সুযোগ থাকত না। কেননা শীর্ষ আদালতের রায়ে অভিযুক্তরা অপরাধী হিসেবে বিবেচিত শুধু নয়, মৃত্যুদণ্ডের মত চরম দণ্ড পেয়েছে। সেক্ষেত্রে ক্ষমাটা হত প্রতীকী।
জহরলাল নেহেরু স্বাধীনতার পরেই বলেছিলেন রাস্তার চৌমাথা তে ল্যাম্পপোস্টে ভেজালদারদের ফাঁসিতে লটকাবেন। কিন্তু বাস্তবে তা হয়নি। কিন্তু একথা সত্যি ফাঁসির ইতিহাস যেটুকু মিলেছে তাতে দেখা যাচ্ছে হাজার দেড়েক বছর আগে পাঁচ এর দশকে ইংল্যান্ডে অ্যাংলো স্যাক্সন উপজাতি চরমতম অপরাধের শাস্তি হিসেবে ফাঁসির চল শুরু করে। মূলত কুসংস্কারবশত কলোজাদুর কারিগর ডাইনিদের বশে রাখতেই ফাঁসির প্রচলন। ফাঁসি হত সর্ব সমক্ষে। হোমারের ওডিসিতে
মেলে ফাঁসির বিবরণে। ফাঁসির বেশি চল শুরু দশম শতকে। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ডের উইলিয়াম দি কনকারের এই প্রথা রদ করেন। আবার প্রথম হেনরি ফাঁসি প্রথা চালু করেন। ১০৫০ সালে রাজা ম্যালকম আইন করেন রাজ্যের প্রত্যেক মেয়র কে নিজের নিজের শহরে স্থায়ী ফাঁসিকাঠ নির্মাণ করতে হবে।
অনেকে বলেন, ফাঁসির আদি দেশ ইরান। সেদিন যা পারস্য নামে পরিচিত ছিল। ফাঁসির আগে হত মুন্ড চ্ছেদ। এছাড়াও জলে ডুবিয়ে ফুটন্ত গরম জলে এমনকি অপরাধী মেয়েদের পুড়িয়েও মারা হত।ইংল্যান্ডে ২২২রকম অপরাধে ফাঁসি দেওয়া হত। মাত্র তিনশো বছর আগেও রাজার হরিণ চুরি করলে, খাবার চুরি করলে, ঘোড়া চুরি করলে ফাঁসি দেওয়া হত।
ফাঁসির পদ্ধতি কালে কালে পাল্টেছে। গাছের ডালে ঝুলিয়ে ফাঁসি হত। ব্রিটেনের ঐতিহ্য মেনেই ভারতে বহু বিপ্লবীকে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।
বিশ্ব জুড়ে মানবতাবাদীরা ফাঁসির বিরুদ্ধে। তাঁদের বক্তব্য, অপরাধীর জঘন্য অপরাধ নিঃসন্দেহে ধিক্কার যোগ্য। কিন্তু সভ্য সমাজে খুনের বদলে খুন শাস্তি হতে পারে না। গোপাল কৃষ্ণ গান্ধীর এক ফাঁসিবিরোধী বইয়ের লেখা উদ্ধৃতি ,,,,, মৃত্যুদণ্ড বিলোপ হওয়া উচিত এই কারণে এটি একটি পূর্ব পরিকল্পিত রাষ্ট্র কর্তৃক হত্যাকাণ্ড। ফৌজদারি অপরাধও বটে। দন্ডজ্ঞাপ্রাপ্ত বন্দীর দেহরাস্ট্রের সম্পত্তি হতে পারে না। আমরা যদি কারও জীবন দিতে না পারি তখন কারোর জীবন কেড়ে নিতেও পারি না। ফাঁসি মানব সভ্যতার প্রাথমিক শর্তকেই লঙ্ঘন করে। অপরাধীর বিচার যদি কিছু ত্রুটি থেকে যায় সেক্ষেত্রে অপরাধীর মৃত্যু কার্যকর হয়ে গেলে পরে তা বদলানোর উপায় থাকে না। এমন উদাহরণ অনেক আছে। যেমন কলকাতার হেতাল পারেখ হত্যা ও খুনের দায়ে ফাঁসি প্রাপ্ত ধনঞ্জয়ের ঘটনা। সত্যি কি সে দোষী? দোষী হলেও সেকি ফাঁসির মতো সাজা পেতে পারে ?
ইন্ডিয়াজ ডটার তথ্যচিত্রের পরিচালক লেসলি এডউইন। নির্ভয়া কাণ্ডের ঘটনা নিয়ে লেসলির ছবি। রোম থেকে তিনি বাংলার এক প্রথম শ্রেণীর সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন , পাঁচ বছর ধরে আসামিদের অপরাধের শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ডের জন্য প্রস্তুত করে হঠাৎ একদিন সকালবেলা স্নান করিয়ে ফাঁসিতে লটকে দেওয়া কোনো সুরাহা নয়। তিনি তিহার জেলে ধর্ষণে অভিযুক্ত ও সাজাপ্রাপ্ত একাধিক বন্দীদের সঙ্গে কথা বলে বুঝেছেন তাদের ধারণা পাল্টাচ্ছে। বন্দীদের সঙ্গে তিনি কথা বলে বুঝেছেন সমাজ ছোট থেকেই যে লিঙ্গ বৈষম্যের পাঠ দেয় তা শুধু ধর্ষকদের নয়, আমাদেরও বর্তায়। মেয়েদের শারীরিক দুর্বলতাকে পুরুষ ভোগের পক্ষে অনুকূল ভেবে নেওয়া কোনো হঠাৎ উপলব্ধি নয়। একজন দলিত বন্দী পরিচালককে বলে সে দলিত। সে ছোট থেকে জেনে এসেছে তার জীবনের কোনো মূল্য নেই। সুতরাং পাঁচ বছরের মেয়েকে ধর্ষণ করার মধ্যে সে কোনো অপরাধ বোঝে না।
Be First to Comment