Press "Enter" to skip to content

ফলহারিণী কালীপুজো ও ষোড়শী….।

Spread the love

ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : ৫ জুন ২০২৪। আগামীকাল ৬ জুন  বৃহস্পতিবার ( বাং – ২৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১ ) আমাদের বাড়ীতে হবে ফলহারিণী কালীপুজো এবং এই উপলক্ষ্যে বের হবে আমার লেখা মনস্তাত্ত্বিক বই ” মন” বইটির পরবর্তী সংস্করণের প্রকাশ ৷ ফলআহরিণী থেকে শব্দটি হয়েছে “ফলহারিণী ” ৷ জ্যৈষ্ঠ মাসের অমাবস্যা তিথিতে মা কালীর যে বিশেষ পুজো হয় তাই ফলহারিণী ৷ মনে করা হয় এই পুজোয় আদ্যাশক্তি মা ভক্তের কর্মফল বা খারাপ কাজ নিয়ে নেন ৷ আমাদের পূর্বস্থলীর চুপী কাষ্ঠশালীর ব্যানার্জী(বন্দ্যোপাধ্যায়) পরিবারের কুল দেবী মা মুক্তোকেশী ৷ আমাদের বাড়ীতে ফলহারিণী কালীপুজো হয় অমাবস্যার মধ্যে পরের দিন সকালে ৷ “মুক্তকেশী ” মানে খোলা চুল ৷ বিলাসবর্জিতা ৷ তিনি অসাধারনের সাধারণ ৷ জগত সংসারের সবকিছু যে তিনি ৷ এই খোলা চুল গতির প্রতীক ৷ এভাবে তিনি ভক্তদের নিজের লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যেতে বলেন ৷ অর্থাৎ যার যা কাজ ভালোভাবে করতে ৷ তবু , আমরা মায়ার ঊর্দ্ধে উঠতে পারি না ৷ অহংকারে মত্ত হই , অহেতুক অভিমান করি ৷ ধনের , দেহের , কুলের গৌরব করি ! অথচ তিনি তাঁর রূপের মধ্যে দেখিয়ে দিয়েছেন নিজের কোমরে অসংখ্য মানুষের হাত বেঁধে রেখে ৷ পূর্ব জন্মের কর্মফল অনুসারে সংসার চক্রে আমরা ঘুরপাক খাচ্ছি ৷ যতদিন না মা মুক্তি দেন ততবার জন্ম নিতে হয় ৷ প্রলয়কালে তিনি সর্ম্পূণ সৃষ্টিকে গ্রাস করেন বলেইতো তিনি “কালী” ! আমরা জানি সূর্য -চন্দ্র- পৃথিবী একই সমান্তরালে এলে অমবস্যাহয় ৷যা এই পূজার সময় ৷ আমার লেখা “সনাতনী কৃষ্টিকথা ” ও “হিন্দু ধর্ম” বই দুটিতে হিন্দু ধর্মের দেবদেবী , পূজা পার্বণ , ধর্মগ্রন্থ , আচার ইত্যাদি বিষয়ে সুবিস্তারে ব্যাখ্যা পাবেন ৷ বস্তু নয় ভাবই প্রধান ৷ তিনিতো বলেছেন ,” নৈবেং পূরতো ন্যাস্ত চক্ষুষা গৃহ্যতে ময়া ৷/ রসং চ দাসজিহ্বায়ামস্নামী কমলোদ্ভব “৷ অর্থাৎ তিনি চোখ দিয়ে আমাদের দেওয়া ভোগ গ্রহণ করেন ৷ কিন্তু , তাঁর ভক্তদের জিহ্বা দিয়েই তা গ্রহণ করেন ৷ মা মহামায়া মুক্তকেশী রূপে সকলের দুঃখ দূর করছেন আবার আনন্দময়ী রূপে সবাইকে আনন্দ প্রদান করছেন ৷কালীকূলের অন্যতম প্রধান সাধক রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব ছিলেন শঙ্করাচার্যের দশনামী সম্প্রদায়ের পুরী মতের সাধু ৷ দশনামী সব মতের নিজস্ব আরাধ্য আছেন ৷ পুরী সম্প্রদায়ের হলো শৃংঙ্গেরী মঠ ৷ আর কাঞ্চিপুরমের শঙ্করাচার্য মঠের দেবী “ষোড়শী ” তাঁদের আরাধ্যা দেবী ৷ এই আশ্রমেরই শঙ্করাচার্য জয়েন্দ্র সরস্বতী আমাদের বিশেষ কৃপা করেছিলেন ৷ কাঞ্চিপুরমের শঙ্করাচার্য আশ্রমে গেলে তিনি আমাদের ঐ প্রতিমা দেখতে বলেন এবং তিনজনকে ( আমাকে , আমার স্ত্রী ও ছেলেকে ) নিজের তিনটি রুদ্রাক্ষ দেন ৷ যা আমার জীবনে মহাপ্রাপ্তি বলে মনে করি ৷ কোন কোন মতে ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র ও সীতাদেবীকে এই অমাবস্যা তিথিতে মা কালীরূপে পূজা করেছিলেন ৷জগতের হিত সাধনের জন্য আদ্যাশক্তির সগুণরূপের এই পূজা দক্ষিণেশ্বর , তারাপীঠ সহ বহু মন্দিরে হয়ে থাকে ৷ এই তিথিতে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ষোড়শী রূপে ফলহারিণীর দিন পুজো করেছিলেন ৷ সারদামণি দেবীকে৷ তাঁর আজীবন সাধনার সব ফল দান করেছিলেন ৷ বাংলায় জ্যৈষ্ঠ হলো মধুমাস ৷ এদিন দেবীর কাছে নিজের প্রিয় ফল দান করলে জগন্মাতা ভক্তের কর্মফল হরণ করে অভিষ্ট ফল বা মোক্ষ দান করেন ৷জগন্মাতা সৃষ্টির আগে যেমন সৃষ্ট জীবের কর্মের বীজ পূরণ করে লুকিয়ে রাখেন ৷ ঠিক তেমনই সৃষ্টির পর সেই সব কর্মবীজের ফল দান করেন ৷তাই,তো তিনি ফলদায়িনী আবার ফলহারিনী ৷ এদিন অনেক ছাত্রছাত্রী লবণ খায় না ৷ গর্ভবতীরা কলা খায় না ৷ কেউ নখ কাটে না ৷তবে,
প্রতিমা গড়ে কালীপুজোর প্রচলন পুরানো নয় ৷
আগে যন্ত্র এঁকে বা খোদাই করে পুজো করা হত ৷
নবদ্বীপের তান্ত্রিক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ কালী
মূর্তি ও কালীপুজোর প্রর্বতন করেন ৷ অষ্টাদশ শতকে নদীয়া রাজ কৃষ্ণচন্দ্র ও তাঁর উত্তরসূরীদের
পৃষ্ঠপোষকতায় সারা বাংলায় কালীপুজো জনপ্রিয়
হয় ৷ এরপর ১৭৭৭ খ্রিস্টাব্দে কাশীনাথ তাঁর
“শ্যামাসপর্যাবিধি” গ্রন্থে এই পুজোর পদ্ধতি প্রথম
লিপিবদ্ধ করেন ৷


“কালী” হলেন আদ্যাশক্তি ৷ বিশ্বব্রহ্মান্ড সৃষ্টির আদি কারন ৷ দুর্গা বা পার্বতীর আরেকটি ভয়াল
রূপ ৷ যাঁর অস্ত্র খড়গ , বাহন শিয়াল ও সঙ্গী শিব ৷
রামকৃষ্ণ দেব বলেছেন , ” এমনি মহামায়ার মায়া
রেখেছ কী কুহক করে , ব্রহ্মা , বিষ্ণু কি তা জানতে
পারে “! সাধকের ভাবনা অনুযায়ী কালী নানারূপে ,
নানা সময়ে , বিভিন্ন নামে পূজিত হন ৷ রক্ষাকালী ,
রটন্তী কালী , ভদ্রকালী , দক্ষিণা কালী , শ্মশান
কালী ৷ তেমনি জ্যৈষ্ঠ মাসের কৃষ্ণা চর্তুদশীতে তিনি
পূজা পান ” ফলহারিণী কালী ” নামে ৷ মহামারী ,
বণ্যা , খরার হাত থেকে রেহাই পেতে যেমন হয় রক্ষাকালী ৷ প্রেম ও অর্থের বাধা কাটাতে মাঘ মাসে
হয় “রটন্তি কালী ” ৷ আমরা ঈশ্বরের কাছে শুধু ভালবাসা ও ভক্তি ভাব চাই না ৷ চাই পার্থিব অনেক
কিছু ৷ তাই মাতৃমন্ত্রে বলি জ্ঞান দাও , ভক্তি দাও ,
অর্থ দাও , সুখ দাও , মান , যশ , সুখ , শান্তি , আরোগ্য দাও এমন কতকিছু ! সন্তানের সে সব কামনা ভক্তি ভরে ডাকলে জগন্মাতা পূরণ করেন ৷ মনে করা হয় “ফলহারিণী কালী পুজোয় ” আমাদের বিদ্যা , অর্থ , কর্ম ও ভাগ্যের উন্নতি হয় ৷

কেটে যায় প্রেম ও প্রণয়ে বাধা ৷ দাম্পত্য ও সাংসারিক জীবনে সুখ ও শান্তি নেমে আসে ৷ “ফলহারিণী কালী ” পুজো বাংলার ধর্মীয় ইতিহাসে আরেক কারণে স্বর্ণাক্ষরে লেখা আছে ৷
১২৭৯ বঙ্গাব্দের জ্যৈষ্ঠ মাসের (২৪শে জ্যৈষ্ঠ / ৫ই জুন ১৮৭২)এই অমাবস্যা নিশীথে তিনি দক্ষিণেশ্বরে আদ্যাশক্তির সগুণের পুজো করেছিলেন ৷ দশ মহাবিদ্যার প্রথম রূপ “কালী” ৷ “কাল” শব্দের দুটি অর্থ “নির্ধারিত সময় ” আর “মৃত্যু” ৷কাল যুক্ত ঈ কালী ৷ ঈ কারে সৃষ্টি ও শব্দ উচ্চারণে হয়েছে ঈশ্বরী ৷ সগুণ ও নির্গুণ ব্রহ্মকে উপলব্ধি করার জন্য ৷ কালী সাধনার সুচনা লগ্নে সাধককে অন্ধকার পথে এগোতে হয় ৷ তারপর নানা পথে ঈশ্বরকে খোঁজে ৷রামকৃষ্ণ দেব শেষ বন্দনা করেন আদ্যাশক্তিকে ষোড়শী ত্রিপুরসুন্দরী রূপে , নিজ স্ত্রী আঠারো বছরের সারদাকে ৷ এতে তিনি দেখান সনাতন হিন্দু ধর্মে নারীর প্রকৃত অবস্থান ৷ গৃহে রমণীর উচ্চস্থান ৷ এমনকি সাধনায় নিজ ভার্যার সহায়তার অপরিহার্যতা !দেবী কালীকা বা ষোড়শী একদিকে যেমন “ফলদায়িনী” ও অন্যদিকে তেমন ” ফলহারিনী ” ৷পরমহংসদেব তাঁর সমস্ত সাধনার ধন নিজ স্ত্রী সারদাকে দিয়েছিলেন৷নিজের জপমালাও মা সারদার কাছে এই দিনে অর্পণ করেছিলেন ৷ জগতের কল্যাণের জন্য মা সারদাকে ” ষোড়শী রূপে ” ফলহারিণী অমাবস্যায় পুজো করেছিলেন ! তিনি মোক্ষপ্রাপ্তির জন্য এদিন যে ফলহারিণী কালী মায়ের পুজো করেছিলেন রামকৃষ্ণ মঠ ও আশ্রমে তাই ” ষোড়শী ” নামে পরিচিত ৷ সৃষ্টির আগে যেমন সৃষ্ট জীবের কর্মের বীজ পূরণ করে লুকিয়ে রাখেন ৷ ঠিক তেমন ভাবেই সৃষ্টির পর সেই সব কর্মবীজের ফল দান করেন ৷ তাই , আমরা এদিন মা কালীর কাছে প্রার্থনা জানিয়ে বলবো ,- ” আমাদের হতাশা , কষ্ট , দুঃখ , দৈন্য দূর করে আনন্দ দাও ” মা আনন্দ
ময়ী ” ! তিনি আমাদের অর্থ , কর্ম , সমৃদ্ধি , সুখ ও শান্তি দিন ৷

আমরা ঘরোয়া পরিবেশে ন’ পোয়া মুক্তোকেশী মায়ের প্রতিমা এনে পূজা করি ৷রাতে অমাবস্যা পড়লেও আমরা পারিবারিক রীতি অনুসারে বাড়ীতে রাতের বদলে দিনে মুক্তোকেশী মায়ের পুজো হয়ে আসছে ৷ঐদিন প্রাণের আকুতিতে মায়ের কাছে গান গাইবো “মুক্ত কর মা মুক্তোকেশি / ভবে যন্ত্রণা পাই দিবানিশি”৷ তাই ফলহারিণীতে মা ” মুক্তোকেশীর ” আরাধনা করি ৷ মা সবার মঙ্গল করুন ৷ সর্ব রোগ হর দেবী ৷ সর্ব পাপ হর দেবী ৷ সর্ব সঙ্কট হর দেবী ৷ সর্ব বাধা হর দেবী ৷ সর্ব অশুভ হর দেবী ৷জয় মা কালী ! প্রণাম মা মুক্তকেশী ৷

More from BooksMore posts in Books »
More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.