Press "Enter" to skip to content

পুরান মতে শুরুতে সরস্বতী বিদ্যার দেবী নয়, ছিলেন প্রজননের দেবী!

Spread the love

সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের তথ্য সমৃদ্ধ প্রতিবেদন: কলকাতা, ২৮শে জানুয়ারি ২০২০ ছিল রুমাল, হয়ে গেল বিড়াল। সরস্বতী দেবী ছিলেন প্রজননের দেবী। বিবর্তনে বদলে হয়ে গেলেন বিদ্যার দেবী। শ্রী পঞ্চমীর দিন ছিল লক্ষ্মী পুজোর দিন। কালে কালে বদলে হলো সরস্বতী পুজোর দিন। এই দুটি তথ্য হজম না হওয়ারই কথা। আজকালতো সরস্বতী পুজো তো হয়ে গেছে বাঙালির ভ্যালেন্টাইনস ডে। কিশোর থেকে পুরুষের উত্তরণ ঘটে কিশোরী থেকে নারী হয়ে ওঠা মেয়েদের চোরা চাউনি দেখে। আমাদের ছেলেবেলা ছেলেমেয়েদের মেলামেশা এতটা খোলামেলা ছিল না ।সরস্বতী পুজোর অপেক্ষা থাকত। স্কুল কলেজের মেয়েরা বাসন্তী রঙের শাড়ি পড়ে আজও অনভ্যস্ত আঁচল সামলে ভীরু চোখে খোঁজে স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র। ছেলেদের মিশন হতো ডিসকভার কুইন। স্বপ্নে দেখা রাজকন্যার খোঁজে। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলছে। এটাই স্বাভাবিক। ফিরে দেখি চলুন শাস্ত্র কি বলছে?

বেদে অবশ্য সরস্বতীর কোনো উল্লেখ নেই। আর্যরা ব্রহ্মাবর্ত নামক স্থানে উপনিবেশ স্থাপন করলে সেই স্থানের নদীর নাম দেন সরস্বতী। বৈদিক যুগে এই নদী ছিল বেগবতী। নদীর অববাহিকায় গড়ে উঠেছিল বৈদিক সভ্যতা। কবি বানভট্ট তাঁর রচনাতে লেখেন , সৃষ্টির শুরুতে সাবিত্রী ও সরস্বতী নদী ব্রহ্মলোক থেকে নেমে মেশে হিরন্যবহ নদীতে। এই নদীর তীরে মিলত সোনার গুড়ো। এখন সেই নদীর নাম শোন নদী। বর্তমানের পালামৌর কাছে বৌদ্ধ যুগের এক গ্রাম ছিল ভান্ডা। এখন নাম বুন্দরিয়া।এই বুন্দরিয়ার পাশ দিয়ে বইত সরস্বতী নদী ভাগীরথীর সঙ্গে মেশে সরস্বতীর একটি শাখা। অন্যটি কালের স্রোতে হয় অন্তসলিলা। সরস্বতী নদী বৈদিকদের এই উপনিবেশকে করত উর্বরা। শাস্ত্রে তাই বলা হয়েছে পরমাত্মার মুখ থেকে সৃষ্টি সরস্বতী। সৃষ্টিকালে তিনি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হন। রাধা,পদ্মা,সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী।

শ্রীকৃষ্ণ এই দেবীকে প্রথম পুজো করেন। সরস্বতী ও শ্রীকৃষ্ণকে কামনা করেন। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে তাই লক্ষ্মী ও সরস্বতী দুজনেই নারায়ণের স্ত্রী। এই ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণেই বলা হয়েছে ব্রহ্মার কন্যা সরস্বতী। কন্যার রূপে মোহিত ব্রহ্মা সরস্বতীকে শয্যাসঙ্গিনী করেন। কবি কালিদাস লিখেছেন, জয় জয় দেবী চরাচর সারে, কুচ যুগ শোভিত মুক্তাহারে। কুচযুগ অর্থ দেবীর দুই সুগঠিত স্তনযুগল। এক স্তনের নাম সত্য। অন্যটির নাম মিথ্যা। এক পুরাণ বলছে সরস্বতী
দধীচি মুনির স্ত্রী নন, কিন্তু সেই মুনির সন্তানের মা। পুরাণ বলছে, সরস্বতী নদী তীরে তপস্যায় মগ্ন ছিলেন মুনি। অপ্সরা অলম্বুষা যাচ্ছিলেন সেই পথ ধরে কোনো দেবতাকে মনোরঞ্জনের জন্য। বিচলিত মুনির বীর্যস্খলন হয়। নদীতে যা পতিত হয়। গর্ভধারণ করেন সরস্বতী।

পুত্র জন্মায় সারস্বত। কোথাও বলা হয়েছে সরস্বতী সূর্যের কন্যা। সরস শব্দের অর্থ জ্যোতি। অর্থাৎ সূর্য। সূর্য্কে পুরুষ ও নারী দুই লিঙ্গ হিসেবে ধরা হত। সূর্যের তাই আর এক নাম সবিতা। পুরুষের নাম হয় সবিতাব্রত। বৈদিক যুগের শুরুতে শ্রী পঞ্চমী তিথিতে লক্ষ্মী দেবীর পুজো হত। শ্রী শব্দের অর্থ লক্ষ্মী। মহাভারতের বনপর্বে (২২৯ অ) শ্রী পঞ্চমী নামের অর্থ উল্লেখ আছে। সেখানে স্কন্ধদেবের সঙ্গে লক্ষ্মী দেবীর বিবাহের উৎসবের কথা আছে। এই লক্ষ্মীদেবী দেবরাজ ইন্দ্রের মাতৃস্বসার কন্যা। শ্রী যে তিথিতে স্কন্ধের আশ্রয় গ্রহণ করেন সেদিন ছিল শ্রী পঞ্চমী। পরবর্তীকালে সম্ভবত উর্বরতার দেবী ষষ্ঠী দেবীর সঙ্গে প্রজননতার নিরিখে একাত্ম হয়ে পড়েন পুরণকারের খেয়ালে।
সরস্বতী যে উর্বরতার দেবী হিসেবে বৈদিক যুগের শুরুতে পরিচিত ছিলেন তার প্রমাণ, এই পুজোর অন্যতম উপকরণ লাল পলাশ ফুল। ঋতুমতী নারীর রজো দর্শনই প্রাণী জন্মের প্রধান শর্ত। বাংলার ময়মনসিংহ জেলাতে এই পুজোতে মেষ বলির প্রথা আছে। মেষও নাকি শাস্ত্রে বলেছে সরস্বতীর বাহন। মেষ মানে ভেড়া। ভেড়ার প্রাচীন শব্দ মেড়া। শব্দটি এসেছে মেট্র থেকে। যার অর্থ লিঙ্গ। আমরা দেবীর বহন হাঁস দেখে অভ্যস্ত। হাঁস প্রজনন ক্ষমতা তে শক্তিশালী। কামুক। ব্রহ্মার বাহন ও হাঁস। আবার দক্ষিণ ভারতে দেবীর বাহন ময়ূর। ময়ূর স্বভাবে পলিগামি। অসংখ্য ময়ূরীকে আকর্ষণ করে পেখম তুলে নৃত্যে। কোথাও আবার দেবীর বাহন মোরগ। মোরগ ভোরের জ্যোতিকে আহ্বান করে। অথর্ব বেদে দেবীকে কামদেবের কন্যা বলা হয়েছে।

ঐতেরেয় ব্রাক্ষণ মতে, দেবীর দুই স্তন দুগ্ধই বৃষ্টিধারা। অমৃত ধারা। উর্বরতার প্রতীক। প্রাণের প্রথম খাদ্য। দেবী ধারণা শুধু ভারতে নয়, পৃথিবীর অনেক দেশে পূজিত। জাপান, যবদ্বীপ, তিব্বতেও সরস্বতীর মন্দির আছে। সরস্বতী শুধু হিন্দু দের সম্পত্তি নন। তিনি বিশ্বমাতা। জাপানে দেবী বেন্তেন নামে পূজিত। চিনে মিয়াও ইন্ তিয়েন মু। রাশিয়ার লেনিন গ্রাদের মিউজিয়ামে চতুর্দশ শতাব্দীর তৈরি ব্রোঞ্চ মূর্তি আছে। গ্রীক দেবী দিমিতা ও এস্থেনার সঙ্গে আমাদের লক্ষ্মী সরস্বতীর মিল আছে।

ঐতিহাসিক ই ও জেমস তাঁর দি কালট অফ দি মাদার গডেস বইতে এবং অন্য ঐতিহাসিকদের লেখাতেও প্রকৃতিকে যে মাতৃ রূপে আরাধনা করা হত সে কথা বলা আছে। প্রয়াত প্রাক্তন কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী প্রতাপ চন্দ্র চন্দ্র তাঁর এক প্রবন্ধে লিখেছেন, হরপ্পা সভ্যতার সমস্ত কেন্দ্রে অবশ্য মাতৃমূর্তি পাওয়া যায় নি। সম্প্রতি রাজস্থানে প্রাচীন সরস্বতী নদীতীরে কলিবাঙানে যে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন খনন করা হয়েছে তাকে প্রাক হরপ্পা ও হরপ্পিয় সুরক্ষিত নগর, ঘরবাড়ি অন্যান্য প্রত্ন সামগ্রী পাওয়া গেছে।কিন্তু তাঁদের মধ্যে মাতৃ দেবীর আরাধনা ধারা অন্যান্য প্রাগ ঐতিহাসিক সমাজে প্রচলিত রয়ে গেল।
__________+++++_________
শেষাংশ আগামীকাল।
আগামীকাল থাকছে পূজার আলপনা কি ডাইনি তন্ত্রের প্রতীক?পৃথিবীতে মাতৃ মূর্তি ধারণা কোথা থেকে এলো?

More from GeneralMore posts in General »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.