*”অ্যালকোহল আমাদের কি কি ক্ষতি করে তা আমরা অনেকেই জানি। কিন্তু শুধুমাত্র জেনে তো কিছু করা সম্ভব নয়, আগে অ্যালকোহল সংক্রান্ত মূল বিষয়টি মানুষকে বুঝতে হবে।”
(বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাঃ মধুরিমা ঘোষ।)
সঙ্গীতা চৌধুরী : কলকাতা, ২৫ মে, ২০২৩। বর্তমানে আমাদের সমাজে অ্যালকোহল একটা গুরুত্বপূর্ণ স্থান করে নিয়েছে। যদিও অনেক দেশের সংস্কৃতিতেই মদ্যপান গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ভূমিকা পালন করে। তবে অধিকাংশ দেশে মদের উৎপাদন, বিক্রয় এবং পান নিয়ন্ত্রণকারী আইন ও বিধিমালা আছে। যেমন- কিছু দেশে প্রকাশ্যে মদ্যপান সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। আবার বিশ্বের কিছু কিছু অঞ্চলে নির্দিষ্ট মাত্রায় মদ্যপান আইনসিদ্ধ। বিশেষ সমীক্ষায় জানা গেছে ২০১৬ সালের হিসেব অনুযায়ী ৩৯% পুরুষ এবং ২৫% নারী মদ্যপান করেন (মোট পরিমাণ ২০৪ কোটি)।
গবেষকরা বলেছেন, ১৫ -৪৯ বছর বয়সী মানুষের ১০টি মৃত্যুর মধ্যে একটি ঘটে মদের কারনে। নিয়মিত মদ্যপান শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ ও টিস্যুতে বিরূপ প্রভাব ফেলে। মদে অভ্যস্ত মানুষ সামান্য কারনেই হিংস্রতা প্রদর্শন করে এবং অনেক সময় নিজের ক্ষতি ডেকে আনে। ২০১৬ সালে সারা বিশ্বব্যাপী এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২.২ শতাংশ নারী ও ৬.৮ শতাংশ পুরুষের অপরিনত বয়সে মৃত্যুর কারণ মূলত মদ্যপান। অন্যদিকে ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সীরা মারা যায় মদ্যপান সংক্রান্ত নানা কারনে (নারী ২৭ শতাংশ এবং পুরুষ ১৯ শতাংশ)।
অ্যালকোহলের খারাপ প্রভাব জানা সত্ত্বেও আমাদের দেশের মহিলা- পুরুষ নির্বিশেষে বিভিন্ন বয়সীরা এই মদ্যপানের দিকে ঝোঁকেন। কেউ কেউ অল্পেই সন্তুষ্ট থাকেন আবার কারো কারো ক্ষেত্রে অত্যাধিক মদ্যপানের আসক্তি দেখা যায় তখন তারা স্বাভাবিক জীবনযাত্রা অতিবাহিত করার থেকে সরে যান এবং তাদের নিকটাত্মীয়দের জীবনেও সমস্যা ঘনিয়ে আসে। অনেকে বলেন অল্প মদ্যপান ক্ষতিকারক নয়, তাতে মানসিক চাপ কমে কিন্তু সত্যিই কি তাই ? এ ব্যাপারে বিশিষ্ট মনোরোগ বিশেষজ্ঞ মধুরিমা ঘোষ কি বলেন জেনে নেওয়া যাক –
” অ্যালকোহল অ্যাডিকশন হল ডিজঅর্ডার, বলা যায় ‘ব্রেন ডিজঅর্ডার’। কিন্তু এটা মানুষ মানতে চায় না। তারজন্য সঠিক চিকিৎসায় পৌঁছতে পারে না, ফলস্বরূপ একটা সময়ের পর সেটা বাড়াবাড়ি পর্যায়ে চলে যায়। তবে এই অ্যালকোহল পানের কিছু কিছু নিয়ম আছে , যেমন – কেউ কেউ পার্টিতে গিয়ে অ্যালকোহল নেন, আবার কেউ মাঝেমধ্যে নেন। সেটাকে আমরা ডিপেনডেন্স বলি না। তবে এটা করতে করতে যা হয় প্রথমে মানুষ মজা করতে গিয়ে নানা অজুহাতে মদ্যপান করেন। আর এভাবেই একটা সময় আসে যখন তা বেড়ে যায়, সে তখন ছাড়তে চাইলেও ছাড়তে পারে না। এটাকেই ডিপেনডেন্স বলে। এই পরিস্থিতিতে তাকে জোর করে ছাড়নোটাও তার শরীরের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়। কারন অ্যালকোহল শরীরে ঢোকার পর ব্রেনে গিয়ে অ্যালকোহল রিসেপটরে লাগে এবং সেটা লাগার পর নানা রকম এফেক্ট শুরু হয়। আর সে সময় যদি আমি জোর করে তার মদ্যপান বন্ধ করে দিই তবে তার ‘উইথড্রল’ হবে, এই উইথড্রলে কিন্তু নানারকম ক্ষতি হতে পারে। তাই অ্যালকোহলের ব্যাপারটা আগে মানুষকে বুঝতে হবে। অ্যালকোহল আমাদের কি কি ক্ষতি করে তা আমরা মোটামুটি সবাই জানি। কিন্তু শুধুমাত্র জেনে তো কিছু করা সম্ভব নয়, আগে অ্যালকোহল সংক্রান্ত মূল বিষয়টি মানুষকে বুঝতে হবে। কিন্তু আমাদের সমাজে এই বোঝার দৃষ্টিভঙ্গিটাই ঠিক নেই। যার জন্য সমস্যাটা বাড়ছে।
অ্যালকোহলের অ্যাডিকশন যেহেতু ‘ব্রেন ডিজঅর্ডার’ তাই এর বায়লোজিক্যালি ট্রিটমেন্টের প্রয়োজন। প্রথমে যখন কেউ অ্যালকোহল নেওয়া শুরু করে তখন তা আস্তে আস্তে ব্রেন সেলসে গিয়ে লাগে এবং তার ক্রিয়া শুরু করে। এরপর শরীরের প্রত্যেকটা টিস্যুকে প্রভাবিত করে অ্যালকোহল গিয়ে ফ্যাটে জমা থাকে। তাই অনেকে যখন বলেন যে আমরা রোজ খাই না সপ্তাহে দু দিন খাই, তার কিন্তু শরীরে অ্যালকোহল থেকে যাচ্ছে। অ্যালকোহল খুব ধীরে ধীরে রিলিজ হচ্ছে। তাই যখন আমরা অ্যালকোহলের চিকিৎসা করবো আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এটা একটা ডিজিজের পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। যেমন- ডায়াবেটিস, হাইপার টেনশন। তাই এটাকে বায়োলজিক্যালি চিকিৎসা করতে হবে। এই ট্রিটমেন্টটা সাধারণত তিনটি ধাপে হয়। প্রথম ধাপে আমরা যেটা করি সেটা হল ‘ওয়াশ আউট’। কোন পেশেন্টকে যখন আমরা এই চিকিৎসার আওতায় আনি তখন প্রথমেই আমরা তার শরীর থেকে অ্যালকোহল বার করে দেব। তবে সেই ব্যক্তিকে অ্যালকোহলের মতন কাজ করে এমন একটা ওষুধ দিতে হবে যাতে ঐ ব্যক্তি যে অ্যালকোহল খাচ্ছে না সেটা অনুভব করতে না পারে। তাতে তার আর কোন সমস্যা হবে না। তা না হলে হঠাৎ করে অ্যালকোহল বন্ধ করে দিলে শরীরে এক ধরনের কেমিক্যাল রিয়েকশন হয় তাকে ‘উইথড্রল’ বলে। এসব ক্ষেত্রে দশ পার্সেন্ট কেসে কিন্তু মৃত্যুও হতে পারে। তাই প্রথমে ‘ওয়াশ আউট’ করা হয়। এই প্রক্রিয়াটা সম্পন্ন হতে দশ থেকে পনের দিন লাগে। এই প্রক্রিয়ার ফলে শরীর সম্পূর্ণরূপে অ্যালকোহল মুক্ত হয়ে যায়।
এবার দ্বিতীয় ধাপে গিয়ে অ্যালকোহল মুক্ত শরীরকে মেইনটেইন করতে হবে। এই সময়টাই কাউন্সিলিং-এর একটা বড় ভূমিকা থাকে। তবে যারা মদ্যপান করেন তাদের সব সময়ই খেতে ইচ্ছে করবে, ব্রেনের ‘ক্রেজিং সেন্টার’থেকে এই ইচ্ছের উদ্রেক ঘটে। এর জন্য একটা ট্রিটমেন্ট আছে ‘ক্রেজিং ম্যানেজমেন্ট’- নামে, যেটা কাউন্সিলিং-এর মাধ্যমে করা হয়। যাতে কারো শরীর অ্যালকোহল মুক্ত হওয়ার পরও যদি খেতে ইচ্ছে করে তবে সে কি করবে। তাছাড়া অ্যালকোহল অ্যাডিকশনের কারন কি ? এই দিকগুলো খুঁজে দেখা হয় এই পর্যায়ে। আর তৃতীয়ত হল পুনরায় যাতে নেশার জায়গায় ফিরে যেতে না পারে তাকে প্রতিরোধ করা।
যে কোন নেশার রোগের প্রবনতাই হল ঠিক হওয়া এবং আবার পুনরায় সেই জায়গায় ফিরে যাওয়া। ব্রেনে সেভাবেই প্রোগ্রামিং করা থাকে। অ্যালকোহল ব্রেনের ভালো থাকার নানা রকম হরমোন এবং নিউরো ক্যামিক্যালসগুলোকে রিলিফ করে, কাজেই ব্রেন পুনরায় সেটাই চাইবে কারন আমি তাকে বিকল্প কিছু দিচ্ছি না।
অ্যালকোহল এমনই একটি জিনিস যেটা শরীরের সমস্ত অঙ্গ এবং কোষকে প্রভাবিত করে। তবে সব থেকে বেশি প্রভাব ফেলে লিভারে, তাই এর থেকে যত দূরে থাকা যায় ততই মঙ্গল। ”
অ্যালকোহলের ক্ষতির দিক গুলো এবার আলাদা করে জেনে নেওয়া যাক-
প্রশ্ন: অ্যালকোহল ব্রেনে কি ভাবে প্রভাব ফেলে ?
উত্তর: অ্যালকোহল প্রথমেই গিয়ে আমাদের ব্রেনের রিসেপটরে লাগে ,তারপর তা সমস্ত শরীরে প্রভাব ফেলে। অ্যালকোহল হল এমন একটি বস্তু যা ব্রেনের সমস্ত চেতনার জায়গাগুলোকে অসাড় করে দিচ্ছে। অনেকে মানসিক উদ্বেগ কমানোর জন্য খান, কেউ বা খান ভালো ঘুমের জন্য বা শারীরিক ব্যাথা কমানোর জন্য- এ ভাবে যে উদ্দেশ্যেই খাওয়া হোক না কেন সেটা সেই মুহূর্তের জন্য কমে কিন্তু পুনরায় ফিরে আসে। আসলে অ্যালকোহল ব্রেনের সমস্ত নার্ভাস সিস্টেমকেই সেই মুহূর্তে অসাড় করে রাখে তাই চেতনাহীন হয়ে যায়।
প্রশ্ন: অনেকের ধারনা অল্প মাত্রায় অ্যালকোহল হার্টের জন্য ভালো, সেটা কি ঠিক ?
উত্তর : অনেক বছর আগে রেড ওয়াইনের ওপর একটা সমীক্ষায়
পুরুষ ও মহিলারা কতটা খেলে ক্ষতিকর নয়, সে রকম একটা পরিমানের কথা বলা হয়েছিল তবে সেটা সর্বজনীন হয় নি। কারন কার শরীরে কতটা বডি ফ্যাট সেটা তো মাপা সম্ভব নয়, তাই অল্পের মাপটা কার কাছে কতটা সেটা ঠিক করা অসম্ভব। তবে আজকাল ভুলেও অল্প করে খাওয়ার কথা বলা হয় না। তাছাড়া অ্যালকোহল এমন একটি বস্তু যার একটি ডোজ শরীরে প্রবেশ করলে খাওয়ার প্রবনতাকে আরো বাড়িয়ে দেয়।অ্যালকোহল কোলেস্টেরলের ব্যালেন্সের দিকটা ঠিক করে, তাতে হার্টের জন্য একটু ভাল তবে এই একটা দিক ঠিক করতে গিয়ে বাকী বহু দিক খারাপ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন : অনেকে মানসিক অস্থিরতা কমিয়ে একটু ভাল ঘুমের জন্য অ্যালকোহল খান, এতে কি সত্যিই ভাল ঘুম হয় ?
উত্তর: অ্যালকোহল রেম স্লিপ সাইকেলটাই এফেক্ট করে। অ্যালকোহল খেলে মনে হয় আমার খুব ঘুম হল, কিন্তু আসলে ঘুমের খুব বিঘ্ন ঘটে। শুধু তাই নয়, পরবর্তীকালে কেউ অ্যালকোহল ছেড়ে দিলেও ঘুমের সমস্যা থেকে যায়। তখন সাধারণ ঘুমের ওষুধগুলোও অনেক সময় এদের ক্ষেত্রে ঠিক মত কাজ করে না। কারন ব্রেন থেকে ঘুমের যে চক্র সেটা নষ্ট হয়ে যায়।
প্রশ্ন: অ্যালকোহল কি ডিমেনশিয়ার ঝুঁকি বাড়ায় ?
উত্তর: মদ্যপানের ফলে খুব অল্প বয়সেই ডিমেনশিয়া আসতে পারে। কারন অ্যালকোহল আমাদের ফ্রন্টাল লোবসের ফাংশনগুলির প্রায় প্রতিটিকেই ব্যাহত করে। আর আমাদের মস্তিষ্কের জ্ঞান, চিন্তা,স্মৃতি এবং বিচার বুদ্ধি – মত দিকগুলো ফ্রন্টাল লোবসের অংশ। তাই যারা মদ্যপান করেন তাদের চারিত্রিক পরিবর্তন আসে। ধীরে ধীরে তারা পাল্টে যেতে থাকে। ফ্রন্টাল লোবসের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজের চরিত্রের বিপরীত কাজ করতে থাকে। এরফলে সে মদ্যপান না করলেও যে কোন কাজে আগের মত মনোনিবেশ করতে পারেন না। কারন তার ব্রেনের ক্ষমতাটাই সে ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলে।
প্রশ্ন : মদ্যপানের প্রবনতা কি জেনেটিক ?
উত্তর: ৮০% ক্ষেত্রেই জেনেটিক। যে পরিবারে অ্যালকোহল খাওয়ার ব্যাপারটি রয়েছে, সেখানে ছোটদের ওপর নজর রাখতে হবে। কারন এই সব ক্ষেত্রে অ্যাডিকশনটা খুব তাড়াতাড়ি চলে আসে।
প্রশ্ন : মহিলাদের ওপর অ্যালকোহলের প্রভাব কেমন ?
উত্তর: মহিলাদের বডি ফ্যাট বা ওয়াটার কনটেন্ট বেশি থাকে তাই মহিলাদের অ্যাডিকশনে চলে যাওয়ার প্রবনতাটা পুরুষদের তুলনায় অনেকটাই বেশি। এটাকে ‘টেলিস্কোপিং ফেনোমেনান’ বলে। মহিলাদের শারীরিক নানা দিকে অ্যালকোহল প্রভাব ফেলে।মহিলাদের নিয়মিত অত্যাধিক মদ্যপানের ফলে অল্প বয়সেই মেনোপজ আসতে পারে। তাছাড়া অ্যালকোহল মহিলাদের বন্ধ্যাত্ব, গর্ভপাত এবং আরো নানা সমস্যার কারন। সন্তান ধারণ করলেও সেখানে সমস্যা আসতে পারে। আবার বাচ্চা হবার পরও বিশেষ এক ধরনের সিনড্রোম দেখা দিতে পারে যাতে বাচ্চা বিভিন্ন রকম সমস্যা নিয়ে জন্মগ্রহণ করে। বেশ কিছুদিন আগেও মহিলারা সামাজিক কারনের এতটা অ্যালকোহল ওপর ঝোঁকেন নি। কিন্তু বর্তমানে তারা আধুনিকতার মোড়কে সেই বাঁধনমুক্ত হয়ে নিজেদের চরম বিপদ ডেকে আনছেন।
পরিশেষে সকলকে এটাই বলবো যে, অ্যালকোহলের এই ভয়ানক পরিণামের কথা অবগত হয়ে নিজেও সাবধান হোন, অন্যকে অ্যালকোহল থেকে দূরে থাকার পরামর্শ দিন।
Be First to Comment