মৃদুলা ঘোষ: কলকাতা, ৩ জুন ২০২০। রাগ একটি স্বাভাবিক আবেশ বা অনুভূতি, যেটা আমার, আপনার সকলেরই কম বেশি আছে। কিন্তু ক্ষণিক রাগ বা ক্ষনক্রোধ যে কোনো মানুষকে ধ্বংস কামী করে তোলে। এই রাগের বশবর্তী হয়েই পরশুরাম কঠোর কুঠারের আঘাতে একুশবার এই বিশ্ব থেকে ক্ষত্রিয় সমাজ কে মুছে ফেলতে চেয়ে ছিলেন। তাই নয় শুধু, চন্ডাল রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য পরশুরাম হত্যা করে ছিলেন নিজের জন্মদাত্রী কে। অন্ধ আর দুঃসহ ক্রোধের এরকম অজস্র লজ্জা ও দুঃখ জনক ঘটনার আমরা প্রতি নিয়ত সাক্ষী থাকছি। তার কিছু ইতিহাস, কিছু ক্রমাগত আবর্তিত হচ্ছে।
রাগের অন্য নাম ক্রোধ, আক্রোশ বা বিদ্বেষ হলেও অনুভূতি গুলি সবসময় এক নয়। যেখানে আমাদের প্রত্যাশা বা চাহিদা পূরণ হয় না, সেখানেই রাগের উৎপত্তি। দৈনন্দিন জীবনে যদিও রাগ কে আমরা নেতিবাচক অনুভূতি হিসাবে মনে করলেও মনোবিদদের মতে দুঃখ, ব্যর্থতা, ভয়, অত্যাচার জনিত মানসিক অনুভূতি কে আয়ত্তে আনার জন্য যে আবেগ বা অনুভূতি প্রকাশ পায়, তাই হলো রাগ। রাগের প্রকাশ মানুষ বিশেষে বিভিন্ন, তা, পরিস্থিতি ও ব্যাক্তিত্বের উপর নির্ভর করে। এখন প্রশ্ন কেন আমরা রাগ করি? কারন অসংখ্য। আমাদের সাথে কেউ খারাপ ব্যবহার করলে, আমাদের কাছে কেউ অন্যায় সুযোগ নিচ্ছে বা ঠকানোর চেষ্টা করছে।
আমাদের উপর কোনও বিষয়ে অবিচার হলে, আমাদের কেউ ক্ষতি করার চেষ্টা করছে, কারও চেহারা, গায়ের রঙ বা কোনো রকম অক্ষমতা নিয়ে বিদ্রুপ করলে রাগ হয়। কারোর দুর্বল জায়গায় আঘাত করলে রাগ হয়, অত্যধিক কাজের চাপ, মানসিক চাপের কারনে ভুল বোঝাবুঝি থেকে রাগ, সংসারে কর্তৃত্ব হারানোর রাগ ইত্যাদি এমন আরো কত কিছুই হতে পারে। বেশিরভাগ সময়, রাগের পিছনের মূল কারণ হচ্ছে আমাদের চাহিদা না মেটা। কেন মাথা গরম হয় তা জানতে গেলে এর উৎস স্থল মস্তিষ্কে পৌঁছে যেতে হবে। সেরিব্রাম বা গুরুমস্তিষ্কের এক বিশেষ অঞ্চল লিম্বিক সিস্টেম, প্রধান গ্ৰন্থি পিটুইটারি আর হাইপোথ্যালামাসের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে লিম্বিক হাইপোথ্যালামাস পিটুইটারি আ্যক্সিস, যেখানে সৃষ্টি হয় ষড়যন্ত্র রিপুর অন্যতম ক্রোধ বা রাগ। রাগ, দুঃখ, ভয় এসবের পিছনে দুটি নিউরো হরমোন আ্যড্রিনালিন এবং ইর আ্যড্রিনালিন এর ওঠানামা।
এদের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় মানুষ রেগে ওঠে, ক্রমাগত চাপা রাগ এই দুই হরমোনের মাত্রা আরো ঊর্ধ্বমুখী করে, যা চক্রাকারে চলতে থাকে। রাগ প্রকাশ করে ই শেষ হয় না, তার আফটার এফেক্ট হল নানা অসুস্থতার বহিঃপ্রকাশ। মারাত্মক হয়, যখন রক্তচাপ বেড়ে আচমকা হার্ট অ্যাটাক হয়, সেরিব্রাল অ্যাটাক এর সম্ভাবনা থাকে। তার সাথে অনেক দীর্ঘ স্থায়ী অসুখের সূচনা হতে থাকে। মেজাজ সপ্তমে চড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অসুখ যেমন আ্যজমা, বাত, এপিলেপসি, হার্টের ক্রনিক ব্যাথা, ডায়াবেটিস, তোতলামি, ইত্যাদি র বাড়াবাড়ি শুরু হয়ে যায়। তাই রাগের বশে বেশিরভাগ সময় ভুল সিদ্ধান্ত হয়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করার কঠিন কাজটি র পদ্ধতি নিজেকেই খুঁজে বার করতে হবে। আমি কিছুতেই রাগবো না- রাগ দমিয়ে রাখার মূল মন্ত্র কিন্তু এটাই। মাথা ঠান্ডা রাখতে যেমন দরকার মানুষে মানুষে বোঝাপড়া, তেমনই দরকার রাগের কারণ ভুলে যাওয়া এবং অবশ্যই ক্ষমা করা। তার সাথে সেন্স অফ হিউমার বাড়িয়ে তুলুন। পরিশেষে বলা যায়, সঠিক সময়ে রাগকে নিজে থেকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখতে হবে।
রাগের বশবর্তী হয়ে কোনো হঠকারী সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। রাগের বেশ কিছু ভালো দিক ও আছে। কেউ অকারনে অপমান করলে, বা আঘাত করলে বা অন্যায় আচরণ করলে তার প্রতি রাগ দেখানো অবশ্যই দরকার, কেননা এর ফলে একজন মানুষের ব্যক্তি সত্তা গড়ে ওঠে। তবে, এটা ঠিক রাগের বহিঃপ্রকাশ যথাযথ হওয়া চাই। রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য না হয়ে রাগ দমন করার এ যুগের ব্যস্ত মানুষের কাম্য হওয়া উচিত। তাতে একদিকে যেমন মানুষে মানুষে সুসম্পর্ক বজায় থাকবে ঠিক তেমনই সুস্থ দেহ মনে দীর্ঘ জীবন পাওয়া যাবে।
Be First to Comment