জন্মদিনে স্মরণঃ ধী রে ন্দ্র না থ গা ঙ্গু লী
নিজস্ব প্রতিনিধি : পুরো নাম ‘ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়’। সংক্ষেপে ‘ডি. জি’। আর এই সংক্ষিপ্ত নামেই বাংলা সিনেমা জগতে তিনি ছিলেন একদা সকলের চেনা মানুষ। আপনার জন।
ডি. জি-বাংলা সিনেমার আদি যুগের প্রখ্যাত অভিনেতা, প্রযোজক, পরিচালক ও চিত্রনাট্যকার। শুধু তাই নয়, বাংলা রঙ্গমঞ্চেরও তিনি ছিলেন দাপুটে অভিনেতা। সাতের দশকে আশি পেরিয়েও তিনি ‘অলীকবাবু’ নাটকে চব্বিশ-পঁচিশ বছরের নায়কের চরিত্রে টানা একশ-রাত্রি অভিনয় করে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
ধীরেন্দ্রনাথের মনে অভিনয়ের প্রতি ভালবাসা জুগিয়েছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। তাঁকে প্রথম মঞ্চে তুলেছিলেন তিনিই। ‘বাল্মীকি প্রতিভা’ নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে তাঁর অভিনয়ে হাতেখড়ি। এই নাটকে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং সেজেছিলেন ‘বাল্মীকি’; আর ধীরেন্দ্রনাথ ‘মায়া’।
রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য পাবার দুটো কারণ ছিল ধীরেন্দ্রনাথের জীবনে। প্রথমত, রবীন্দ্রকন্যা মীরা ছিলেন ধীরেন্দ্রনাথের আপন বৌদি। দ্বিতীয়ত, আত্মীয়তার এই যোগসূত্র ছাড়াও রবীন্দ্রনাথের একান্ত সান্নিধ্যে ধীরেন্দ্রনাথ আসতে পেরেছিলেন বাল্যেই শান্তিনিকেতনে পড়তে এসে।
ধীরেন্দ্রনাথের কৈশোরে হীরালাল সেনেরা যখন থিয়েটারের নাট্যাভিনয় ও পথঘাটের চলমান জীবন ক্যামেরায় তুলে প্রদর্শন করছিলেন, ভ্রাম্যমাণ বিদেশি বায়স্কোপওয়ালারা কলকাতায় তাঁবু খাটিয়ে চলচ্চিত্র দেখিয়ে বেড়াচ্ছিলেন; তখনই ধীরেন্দ্রনাথের ইচ্ছে জেগেছিল চলচ্চিত্র তৈরিকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করার।
কলকাতা তখন সর্বভারতীয় নির্বাক ছায়াছবির পীঠস্থান। আর সেই পীঠস্থানে ছড়ি ঘোরাচ্ছেন ম্যাডান স্টুডিও। তাঁদের হাতে হল আছে, স্টুডিও আছে, মাইনে করা অভিনেতা, অভিনেত্রী, পরিচালক, সঙ্গীত, পরিচালক, গীতিকার, কলাকুশলী আছেন, ছবি আমদানি-রপ্তানির তাঁবেদারি আছে। ফলে, ধীরেন্দ্রনাথ ছবি বানাবার স্বপ্ন নিয়ে তাঁদের সঙ্গেই যোগাযোগ করলেন।
ম্যাডান কর্তৃপক্ষ জানালেন যে, তাঁরা রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’ নাটকটি চলচ্চিত্রে রূপান্তরিত করতে চান। কিন্তু কবি অনুমতি দিচ্ছেন না। ধীরেন্দ্রনাথ যদি অনুমতি আদায় করে আনতে পারেন, তাহলে তাঁকে দিয়েই এই ছবি পরিচালনা করানো হবে।
রবীন্দ্রস্নেহধন্য ডি জি’র কাছে এ আর বেশি কথা কী! তিনি গেলেন এবং রবীন্দ্রনাথের সানন্দ অনুমতি নিয়ে এলেন। আর নিয়ে এসেই এক নিদারুণ সত্যের মুখোমুখি হলেন। জানতে পারলেন যে, ছবিটা মোটেই তাঁকে দিয়ে পরিচালনা করানো হবে না, রবীন্দ্রনাথের কাছ থেকে অনুমতি আদায়ের তিনি একটা টোপমাত্র! সত্যটা তাঁকে গোপনে জানালেন অবাঙালি ম্যাডান কোম্পানির বাঙালি জেনারেল ম্যানেজার, নীতিশ লাহিড়ী।
সত্য জেনে ধীরেন্দ্রনাথ অত্যন্ত বিরক্ত হলেন, কিন্তু মুষড়ে পড়লেন না। কোন অবাঙালির সাহায্য না-নিয়ে বাঙালির টাকায় ছবি তৈরির জেদ ধরলেন। এই জেদে তাঁর সহায় হলেন নীতিশবাবু। টাকা দিতে রাজি হলেন পি এন দত্ত নামের এক ভদ্রলোক। তিনের মিলিত প্রচেষ্টায় বনহুগলির এক বাগানবাড়িতে স্টুডিও তৈরি হল। স্টুডিওর নাম দেওয়া হল, ‘দি ইন্দো ব্রিটিশ ফিল্ম কোম্পানি’।
ধীরেন্দ্রনাথ নিজে কাহিনি লিখলেন, চিত্রনাট্য লিখলেন। শুরু হল শ্যুটিংয়ের আয়োজন। ক্যামেরাম্যান হিসেবে দলে এলেন পরবর্তীকালের বিখ্যাত ক্যামেরাম্যান জ্যোতিষ সরকার। শ্যুটিং শুরু হল। নায়কের চরিত্রে অভিনয় করলেন ধীরেন্দ্রনাথ নিজে। নায়িকার চরিত্রে অভিনয় করালেন উকিল বিধুভূষণ মুখোপাধ্যায়ের মেয়ে সুশীলা দেবীকে দিয়ে।
এভাবে তৈরি হল ধীরেন্দ্রনাথের প্রথম ছবি ‘বিলেত ফেরৎ’ বা ‘ইংল্যান্ড রিটার্ন’। এটিই প্রথম পূর্ণাঙ্গ নির্বাক ছবি, যা সম্পূর্ণরূপে বাঙালি প্রযোজক, বাঙালি পরিচালক, বাঙালি চিত্রগ্রাহক, বাঙালি অভিনেতা-অভিনেত্রী ও বাঙালি কলাকুশলীদের পরিশ্রমে নির্মিত।
এমনকি ছবিটি প্রদর্শিতও হয়েছিল বাঙালি নির্মিত, বাঙালি মালিকের হলে। সেই হলের নাম, ‘রসা থিয়েটার’; যা পরবর্তীকালে ‘পূর্ণ থেয়েটার’ -এ নামান্তরিত হয়। ১৯২২ সালের ৪ জুন এই হলে ‘বিলেত ফেরৎ’ মুক্তি পায়।
ধীরেন্দ্রনাথের প্রথম ছবি ‘বিলেত ফেরৎ’; আর শেষ ছবি ‘কার্টুন’- যা মুক্তি পায় ১৯৫৮ সালে। ধীরেন্দ্রনাথ এই কালপর্বে মোট তিপ্পানটি ছবি নির্মাণ করেন।
ধীরেন গাঙ্গুলী অভিনীত চলচ্চিত্র সমূহঃ ‘বিলাত ফেরৎ’, ‘শেষ নিবেদন’, ‘বন্দিতা’, ‘মরণের পরে’, ‘পঞ্চশর’, ‘শঙ্করাচার্য’, ‘অলীকবাবু’, ‘সাধু আউর শয়তান’ প্রভৃতি।
পরিচালিত ছবি- ‘কার্টুন’, ‘শেষ নিবেদন’, ‘শৃঙ্খল’, ‘দাবী’, ‘আহুতি’, ‘দ্বীপান্তর’, ‘বিদ্রোহী’, ‘চরিত্রহীন’, ‘ইন্দ্রজিৎ’, ‘হর-গৌরী’ প্রভৃতি চলচ্চিত্র।
১৯৭৪ সালে পেয়েছেন পদ্মভূষণ। ১৯৭৫ সালে লাভ করেন দাদা সাহেব ফালকে পুরস্কার।
১৯৭৮ সালের ১৮ নভেম্বর কলকাতায় ধীরেন গাঙ্গুলীর মৃত্যু হয়।
ধীরেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় (ডি জি) ১৮৯৩ সালের আজকের দিনে (২৬ মার্চ) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment