সুজিৎ চট্টোপাধ্যায়: আপাত দৃষ্টিতে দোলযাত্রা আর হোলি রঙের উৎসব মনে হলেও আদপে যা আলাদা আলাদা। দোলকে যদি পূর্ব ভারতের উৎসব তো হোলি উত্তর পশ্চিম ভারতের উৎসব।
প্রথমে বলা যাক দোলের কথা। দোল শব্দটা এসেছে দোলারোহণ থেকে। ফাল্গুনী পূর্ণিমা তিথিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দোলনায় বসিয়ে পুজো করার রীতি থেকেই দিনটির নাম দোলপূর্ণিমা।
হিন্দু শাস্ত্রে ন ধরণের রসের কথা বলা আছে।শৃঙ্গার রস অর্থ রতি, হাস্যরসে হাসি, করুণরসে শোক, রৌদ্র রসে ক্রোধ, বীর রসে উৎসাহ, ভয়ানক রসে ভয় , বিভৎস রসে ঘৃণা, অদ্ভুত রসে বিস্ময় এবং শান্তি রসের অর্থ শান্তি।এই রসগুলির বিভিন্ন প্রতীকী রং আছে।যেমন শৃঙ্গার রসের রং। কালো,রুদ্রের প্রতীক লাল,হাসির প্রতীক সাদা, করুণা রস ধূসর, ভয়ানক এর রঙ কালো, বিভৎসের রং সবুজ অদ্ভুত রস হলুদ।
সব দেশেরই মূল আরাধনা সূর্যের।খ্রিস্টানদের ইস্টার, ব্যাবিলন আর নেপলস এর মিড সামার ইভ,ভারতের দোল হোলি সবই সূর্যের পুজো ।যার আর এক নাম ঋতু বন্দনা ।আগেই বলেছি প্রথমে দোলের কথা বলবো।বিজ্ঞান বলে,এই বসন্ত ঋতুতে মানুষের যৌনাবেগ বাড়ে। যে যৌনতা সৃষ্টিসুখের উৎস।বাৎস্যায়নের কামসূত্রে বসন্তকে কাম উৎসব কাল বলা হয়েছে । বাংলায় আচার্য্ যোগেশ চন্দ্র রায় বিদ্যানিধি দোলযাত্রাকে বর্ষবরণ দিবস হিসেবে জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনায় বর্ণনা করেছেন আগে কিন্তু দোলযাত্রা অনেক আগে হতো।৩১৯খ্রিস্টাব্দে পৌষ সংক্রান্তিতে উত্তরায়ণে দোলযাত্রা হতো। ন হাজার বছর আগে যা হতো চৈত্র পূর্ণিমায়।শুধু বাংলা নয়, পূর্বাঞ্চলে দোলের প্রচলন ১৩৩১সালে হরিহর শেঠ লেখেন,উত্তরপাড়ার মজুমদার বাড়িতে প্রথম বাউলের দল গাওনা করে।বছর দেড়শো আগেও দোলের ছুটি ছিলো পাঁচদিনের।তখন দুর্গাপুজোর ছুটি ছিলো একদিন।শ্রী চৈতন্যমহাপ্রভুর জন্মদিন এই দিনে হওয়ায় এই উৎসব বাংলায় জনপ্রিয়তা পায়।ধর্মের উর্ধে উঠে রবীন্দ্রনাথ দোল উৎসবকে ঋতু বন্দনায় ফিরিয়ে আনেন।
রঙে, রূপে ফাগে, রসে, সঙ্গীতে ও নৃত্যের মিশেলে আজ বাঙালির কাছে যা অহংকার। সম্ভবত ১৯২৫ এ শান্তিনিকেতনে প্রথম বসন্ত উৎসব আয়োজিত হয়। রবীন্দ্রনাথ শেষবার এই উৎসবে হাজির ছিলেন ১৯৪০ এর ২৭ মার্চ। পরের বছর অসুস্থতার জন্য কলকাতায় বসে লিখলেন, আবার ফিরে এলো উৎসবের দিন,বসন্তের অজস্র সম্মান,রুদ্ধ কক্ষে দূরে আছি আমি এ বৎসর বৃথা হলো পলাশবনের নিমন্ত্রণ।রবীন্দ্র অনুরাগীরা কণ্ঠ মেলান,ওরে গৃহবাসী খোল দ্বার খোল ,আর রাঙিয়ে দিয়ে যাও যাও যাও গো গানে। সময়ের বিবর্তনে উৎসবের সংজ্ঞা বদলে যায়।এখন রবীন্দ্র ভারত বিশ্ববিদ্যালয়ে অশ্লীল শব্দের প্রয়োগ নিয়ে হইচই চলছে অথচ বাংলার দোলে মদ , গাঁজা,সিদ্ধি খাওয়া আর খিস্তি খেউড় করা ছিল উৎসব পালনের অঙ্গ।কালিকা পুরাণ বলছে,এদিন রবির অর্থাৎ সূর্যের উত্তরায়ণ।বছরের প্রথম দিন।এদিন চোখ , কান,, নাক, জিভ, ত্বক অশুচি রাখলে যমদূত স্পর্শ করে না।তাই দোলযাত্রা র দিনে রাস্তায় দলে দলে মানুষ অশ্লীল কাঁচা খিস্তি দিয়ে অশ্লীল গান গেয়ে নগর পরিভ্রমণ করত । এটা বাঙালির সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল।
এবার বলি হোলির কথা। ভাগবত পুরাণ বলছে,বিষ্ণু দৈত্য (নাকি অনার্য?) হিরণ্যকশিপু র হাত থেকে বিস্নুভক্ত প্রহ্লাদ কে বাঁচাতে হোলিকা নামে এক রাক্ষসী (নাকি অনার্য রমণী)কে ভস্ম করেন ।যুক্তিবাদী বলেন,হোলিকা ছিলেন বিদুষী অনার্য মহিলা । অনার্য রাজা হিরণ্যকশিপু র বোন। তাকে পুড়িয়ে মারা হয় যাতে তার নেতৃত্বে আর্যদের আগ্রাসী অনার্য ভূমি দখলের আগ্রাসন আটকাতে না পারে।যা আর্য্ সভ্যতায় বলা হয় অশুভের বিনাশ।যা নেড়া পোড়া ,বুড়ির ঘর পোড়ানো নামে পরিচিত হ য়ে উঠেছে।অনেকে বলেন, উজ্জয়িনীর রাজা ইন্দ্রদুম্ন হোলি উৎসব চালু করেন।কেউ বলেন, দ্বিতীয় তৃতীয় খ্রিস্টাব্দে সাতবাহন রাজা হোলি চালু করেন। নেড়াপোড়ার কথা স্কন্ধ পুরাণেও আছে। মেন্টা নামে এক অসুর (অনার্য) সূর্যের উত্তরায়ণের পথে বাধা সৃষ্টি করে।সে পুড়ে মরলে বাড়বে রোদের (আর্য আগ্রাসন) তেজ।
মোগল কালে মুসলিমরাও হোলি খেলতেন।আইনি আকবরিতে যার উল্লেখ আছে। হোলিকে তারা বলতেন ঈদ _ই_গুলাবি।জাহাঙ্গীরের কাছে ছিল হোলি প্রিয় উৎসব। তার আত্মজীবনী তুমুক_ই_জাহাঙ্গীরী তে তিনি বলেছেন, অব ই পাশান। দোল খেলতেন শাজাহান, আওরঙ্গজেব পৌত্র আজিম উসান মীরজাফর।মীরজাফরের পুত্র মুবারুকদ্দৌলা হিন্দু প্রজাদেরসঙ্গে দোল খেলতেন। দোল বা হোলিতে আবির প্রধান উপাদান।পৌরাণিক তথ্য বলছে,আবির বা ফাগ শব্দটা এসেছে ফল্গু থেকে।যা ব্রহ্মার ঘাম থেকে তৈরি।কলকাতায় দোলের ইতিহাস টা না বললে খুব অন্যায় হবে।লালমোহন শেঠ ছিলেন কলকাতার বনেদি ধনী। দোল খেলার জন্য যিনি পুকুর খনন করেন ।অফিস পাড়ায় যা আমরা আজ লালদীঘি নামে জানি।লালদীঘির পাড়ে বসত আবিরের বাজার। হিন্দু আর্য সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎসব হোলি ঋতু বন্দনার উৎসব হিসেবে পরিচিতি লাভ করে বৌদ্ধ ধর্মের বিকাশের ফলে।বিবর্তনে বৌদ্ধ ধর্মকে হঠিয়ে হিন্দু ধর্ম আবার মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে ।
বিকাশ ঘটে বৈষ্ণব সংস্কৃতি।
ভারতে নানা রাজ্যে এই হোলি নানা নামে পরিচিত। গো বলয়ে যা হোলি,দক্ষিণে কামন পন্ডিগাই, গোয়াতে শিমাগা,পঞ্জাব হল্লা মহল্লা, হরিয়ানাতে দুলহনদি,এছাড়াও হোলি হোরি, মেটে হোলি মাইট্যা হোলি, আহেরিয়া, ফল্গুৎসব, মদনোৎসব নামেও পরিচিত। ঐতিহাসিকদের বক্তব্য, হোলি শুধু ধর্মীয় উৎসব নয়,ভারতের কুমায়ন উপত্যকায় গাছ কেটে তাতে আগুন ধরিয়ে নারী পুরুষ বৃত্তাকারে ঘুরে ঘুরে নৃত্য করত। কোথাও পাঁচদিনব্যাপী আগুন জ্বালিয়ে বসন্ত বন্দনা কে চিড় উৎসব বলে।এই উৎসব যে শুধু আমাদের দেশেই পালিত উৎসব টা নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে উদযাপিত হয়।লাতিন আমেরিকায় ডনকি ও তেন্সু পাতার রস থেকে লাল পাউডার রং তৈরি হতো।এই পাতা মিলত বুতিয়া ফ্রনদো সা নামে এক গাছ থেকে।এই রং খেলার উৎসব আদিম ইউরোপিয়ানরা পালন করত মে মাসের প্রথম দিনে।বসন্তের দেবী ফ্লোরার আরাধনার দিন। বেন্টিক সভ্যতায় হতো বেলতান উৎসব। অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে বলি দেওয়া হতো পশু ।
এমনকি হতো নরবলিও।সারা গায়ে ডিম মেখে মদ্য পান করে নাচানাচি হতো। বিশাল কেক তৈরি হতো।অশ্লীল গালি অঙ্গভঙ্গি নাচ গান হতো।পুজো হতো রহস্যময়ী যৌন দেবী লুপারকালিয়া আন্না পেতেত্রার।১৭ মার্চ হতো লিবেরালিয়েতে হতো বাখাসে উৎসব। ভারতসহ পূর্বদেশ যোয়ের আনন্দে ইতালিতে এই উৎসবের সূচনা। আজও ইউরোপে ও জাপানে। জল ছুড়ে আর টমেটো ছুড়ে খেলা হয়। হোলিতে মানুষ নেশা করে কেন?এই প্রশ্ন রাজা পৃথ্বীরাজ তার সভাকবিকে জিজ্ঞাসা করেন।তিনি রাজাকে এক পৌরাণিক কাহিনী শোনান। চৌহান বংশে ঢুন্ত্য নামে এক নর রাক্ষস জন্মায়। তাঁর বোন ও ছিল রাক্ষসী। ঢুন্ত্যা রাক্ষ সের ধারণা ছিল দেবতাদের চক্রান্তে তার ভাইএর মৃত্যু হয়। তাই সে দেবী অন্নপূর্ণার তপস্যা করে সফল হয়।দেবীর কাছে সে বর চায় পৃথিবীর মানুষ যেন তার খাদ্য হয়।
দেবী বর দিতে বাধ্য হন।সমাধান করেন মহাদেব।তিনি বলেন যে মানুষ হোলির দিনে নেশা করে গালি দিয়ে শোরগোল করে উৎসব পালন করলে রাক্ষস রাক্ষসী তাদের বধ করতে পারবেন না ।ফলে ভারতের মানুষ প্রাণে বেঁচে যায়। বৈষ্ণববাদীদের উৎসাহে হোলি আজ রাধা কৃষ্ণের রং খেলার উৎসবে পালিত হচ্ছে।পাশাপাশি ঋতু বন্দনা যৌনতার প্রতীক হয়ে নারী পুরুষের প্রেমের উৎসবে পরিণত হয়েছে। পাঠক আপনাদের নিশ্চই কালিদাসের মালবিকা গ্নিমি ত্রম এর গল্পটা মনে আছে। দোলের দিনে মালবিকা ও মহারাজ অগ্নিমিত্র র চার চোখে চোখাচোখি।
তার ফলেই মস্তিষ্কে অক্সিটোসিনের ক্ষরণ।এবারের হোলিতেও হয় তো কত মালবিকা ও অগ্নিমিত্রের চার চোখের হঠাৎ মিলনে হয়েছে নতুন রসায়ন। আর যাদের এবার সুযোগ মিলল না , মাইরি বলছি আসছে বছর হবেই হবে।
Be First to Comment