ভাস্কর ভট্টাচার্য: ঢাকা, ১৫মে ২০২০। গতকাল একই দিনে মাত্র ঘণ্টা কয়েকের দূরত্বে দু দুটি প্রিয় মানুষের বিদায়। প্রথমে চিন্তাবিদ, লেখক রবীন্দ্র গবেষক, প্রফেসর ড. আনিসুজ্জামান, এবং একই তিথি নক্ষত্রে বিশিষ্ট লেখক ও প্রবন্ধকার দেবেশ রায়। ফেসবুকে কালো স্ক্রিনের মধ্যে সাদা অক্ষরে কে যেন লিখেছেন দেবেশ রায় প্রয়াত। বুকের মধ্যে দলা পাকিয়ে উঠল একরাশ স্মৃতি। আমার সাংবাদিক জীবনের প্রথম ইন্টারভিউ এ মুখোমুখি ,আমি দেবেশ রায়। পূর্ণেন্দুদা অর্থাৎ পূর্ণেন্দু পত্রী পরিচয় করালেন, দেবেশ এই ছেলেটাকে দেখো তো তোমার কাজে লাগে কিনা। সেদিন যদি দেবেশদা আমায় ইন্টারভিউ নিতেন, তা হলে আজ এ লেখা লিখতে পারতাম না। কারণ নির্ঘাত সফল হতাম না সেদিন। চাকরিটা হত না। জীবন হয়ত অন্য পথে বইত। কিন্তু ঘটনাচক্রে দেবেশদা সেদিন বলেছিলেন, কাজ শুরু করুন পরে কথা বলে নেব। উনি ব্যস্ত ছিলেন। ‘প্রতিক্ষণ’ সেদিন সাড়া জাগানো পত্রিকা। কত বছরের সম্পর্ক। তিনি চলে গেলেন।
এই তো গত বছরও ১লা বৈশাখের বিকেলে দেখা। কলেজ স্ট্রিটের দে’জ পাবলিশিং এর ঘরে। আরে আসুন, আসুন বসুন। গিয়ে একটু দূরে বসলাম। কুশল বিনিময়। লোকজন ভিড় বাড়ল লেখককুলের। আমি লেখক নই কোনোদিনই। ঘর হালকা হয়েছে দেবেশদা অনুযোগের সুরে বললেন, আপনি আমার পাশে এসে বসলেন না? নিজেকে নিজেই এতটা কুঁকড়ে যেতে দেখিনি। পাশে বসলাম। ছবি তুললাম। খুশি হলেন। উনি কোনোদিন তুমি বলেননি। সম্পর্ক প্রতিক্ষণ পত্রিকা থেকে। যোগাযোগ কোনোদিন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকেনি বটে কিন্তু সম্পর্ক ছিন্ন হয়নি কোনোদিনই। অর্থাৎ উনি ভুলে যাননি। যেখানে দেখা হয়েছে সেখানেই আন্তরিক সম্ভাষণ। দেবেশ রায়ের লেখার ভক্ত ছিলাম এক সময়। বাংলা গদ্যের যে জোরাল ধার, তাঁর লেখায় পেয়েছিলাম। তিস্তা পারের বৃত্তান্তের একটা অংশ প্রতিক্ষণ পুজো সংখ্যায় বেরিয়ে ছিল। পাণ্ডুলিপি পড়ে চমকে উঠেছিলাম।
ফ্যাতাড়ুর জীবন বেত্তান্ত সমস্ত পাঠককে মুগ্ধ করেছিল। নাম হয়েছে, বই সম্মানিত হয়েছে। দেবেশদা খ্যাত হয়েছেন। তার মানে এখানেই শেষ নয়। একটা প্রেমের গল্প সংকলন আছে, যা অনুভবী পাঠক বুঝতে পারবেন প্রেমের গল্পের ধাঁচ কিভাবে ভিন্ন ধারায় লেখা যায়। বিস্তর লেখা। অনেক লিখেছেন। সব লেখা সব পাঠককে সব সময় সমানভাবে টানেনি, টানে না। ‘আপাতত শান্তিকল্যাণ হয়ে আছে,’ ‘ধর্ষণের পরে যে রকম হয়ে থাকে’, রিপোর্টাজ ধর্মী উপন্যাসে মনোনিবেশ করেছিলেন পরের দিকে। শেষ ছোট্ট লেখা পড়েছি এ বছর পুজোয় ‘ এই সময়’ পত্রিকায়। তাঁর ‘বরিশালের যোগেন মণ্ডল’ বইটি সম্ভবত বাংলা জীবনী ভিত্তিক সবচেয়ে বেশি পাতার উপন্যাস। যযাতি, সময় অসময়ের বৃত্তান্ত প্রভৃতি সাড়া ফেলেছিল।
এমন গভীর নিষ্ঠ পাঠক পাওয়া দুর্লভ। ছোট বড় নামী অনামী সমস্ত লেখকের লেখা পড়তেন। এক আলোচনায় জেনেছি। সাহিত্য একাডেমির সভাপতি হয়েছিলেন । পশ্চিমবঙ্গ বাংলা একাদেমি থেকে তাঁরই উৎসাহে বের হত ‘বইয়ের কাগজ’। কোন প্রকাশক কী বই বের করছেন তার খবরাখবর থাকত। যা অভিনব। দলিত সাহিত্য নিয়ে গল্প সংকলন বোধহয় তিনিই প্রথম করেছিলেন। সে বইয়ের ভূমিকাই যেন ইতিহাস। দেশ বিভাগের গল্প সংকলন করেছিলেন। উত্তর বঙ্গ থেকে কলকাতায় পাকাপাকি ভাবে চলে এলেও উত্তরবঙ্গের তিস্তা, গাজলডোবাকে মনে হয় শেষ দিন পর্যন্ত প্রাণের মতো ভালবাসতেন এবং চিনতেন। তাই বার বার বাংলাদেশে জল বণ্টনের সময়ে সরব হয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। সরকার না শুনলেও। একটা গল্পে পড়েছিলাম প্রথম জীবনে বাস্তবিকই সোনাগাছিতে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতে গিয়ে দেখেছিলেন আদিম ব্যবসার কী নির্মম নির্লজ্জ চেহারা।
যা তিনি গল্পে তুলে ধরেছিলেন। তাঁর গবেষণার অন্ত ছিল না বিষয়ের। “আঠারো শতকের বাংলা গদ্য ও সাংবাদিকতা” এক অমূল্য গবেষণা। ওই শতক নিয়ে আরও একটি বই আছে। সম্ভবত চিঠিপত্রে আঠারো শতকের ভাষা এই নামে। যাই হোক, শিক্ষকতা দিয়ে পেশা শুরু। শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন। শেষ সম্পাদিত পত্রিকা “সেতু।’ বেশ আকর্ষণীয়। শেষ দিকে কানে কম শুনতেন কিন্তু প্রখর স্মৃতিশক্তি। এ যাঁরা মিশতেন তাঁরাই জানেন। আজীবন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন এবং সেই ঘরানার লেখক গরিমা নিয়েই চলে গেলেন। কোনোদিন বামপন্থী দৃষ্টি থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি। তাঁর চলে যাওয়ায় বড় মেদুরতায় মনে পড়ছে, “আরে কেমন আছেন। কতদিন দেখিনি। ‘ এমন বলার লোক কমেই যাচ্ছে। লেখক মর্যাদা নিয়েই বেঁচেছিলেন। একটা ছোট্ট ঘটনা বা গল্প দিয়ে শেষ করব। পয়লা বৈশাখ, প্রকাশকের ঘর। সমরেশ মজুমদার, সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় পাশাপাশি তিনজন বসে। একটা অদ্ভুত ঘটনা ,কেউ কারও সঙ্গে কথা নেই। অন্যান্যরা নানা প্রশ্নোত্তর চলছে, হঠাৎ দেবেশদা প্রশ্ন করলেন বলুন তো কোন লেখকের লেখায় ভূত বেশি এসেছে। সবাই চুপ।
তিনিই উত্তর দিলেন, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। সবাই মুখ চাওয়াচায়ি করলেন। একেই বলে পাঠক। তিনিই জীবনানন্দ দাশকে বাঙালি পাঠকের কাছে নতুন আবিষ্কার বা তুলে ধরেছিলেন। তাঁরই উদ্যোগে এবং সম্পাদনায় প্রতিক্ষণ প্রকাশনা থেকে জীবনানন্দ গল্প উপন্যাস সমগ্র প্রকাশ হবার পর বাংলা সাহিত্যের পাঠকরা এক নতুন জীবনানন্দকে পেয়েছিলেন, কবির বাইরের জীবনানন্দ দাশ। মনে পড়ছে। মনে পড়বে। আরও কত কথা। ভয় পাওয়া দিয়ে শুরু ভালোবাসা দিয়ে শেষ। করোনা আবহে নিঃশব্দে চলে গেলেন।
Be First to Comment