সুজিৎ চট্টোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৯শে জানুয়ারি ২০২০ সরস্বতীর বাহন হাঁস। নিদেনপক্ষে ময়ূর নজরে এসেছে। কিন্তু জলচৌকি? হজম হওয়া শক্ত। কিন্তু তথ্য তো তাই বলছে। আসলে আর্য্ সংস্কৃতির বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে দেবী সরস্বতীর সংজ্ঞা পাল্টেছে। বৈদিক যুগ পেরিয়ে পুরাণ সংস্কৃতিতে সেদিনের শাস্ত্রজ্ঞ ব্রাহ্মন পণ্ডিতেরা নিজেদের মনের মাধুরী মিশিয়ে দেবী বর্ণনা দিয়ে গেছেন। পদ্ম পুরাণে সরস্বতী দক্ষ কন্যা এবং কাশ্যপ পত্নী বলা হয়েছে। আবার ব্রহ্ম বৈবর্ত পুরাণে সরস্বতী বিষ্ণুর স্ত্রী। শিব পুরাণ ও স্কন্ধ পুরাণে সরস্বতীকে শিবের স্ত্রী বলছে। বিদ্যা দেবী হিসেবে ভারতে পূজিত হলেও বিদেশেও কিন্তু সরস্বতীর পুজো আছে। জাপানে বেন্তেন, চিনে তিয়েন মু নামে দেবী পরিচিতা।
এদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেবী চতুর্ভূজা এবং ময়ূর বাহন। অনেক ক্ষেত্রে মোরগকেও বাহন বলা হয়েছে। বাংলাতে বৌদ্ধ সংস্কৃতি হিন্দু আগ্রাসনে যখন অস্তমিত সেই মুহূর্তে বৌদ্ধ সম্প্রদায় স্পষ্টত দুটি ভাগে ভাগ হয়ে যায়। বুদ্ধদেবের অনুরাগী দের নামকরণ হয় হীনযান । আর যারা হিন্দুদের কাছাকাছি চলে যান তাঁদের পরিচয় হয় মহাযান নামে। জানা দরকার বৌদ্ধদের ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক কিন্তু জীবদ্দশায় দেখে যেতে পারেননি। হিন্দু সংস্কৃতির সংস্পর্শে দেবী হয়ে যান ত্রিপিটকের রক্ষার দেবী। ফলে বৌদ্ধ দেশগুলিতে আজও দেবীর পুজো হয়। বৌদ্ধ ধর্মে হিন্দু সংস্কৃতির আগ্রাসনে কালী দেবীর পুজোও আছে। তিনি এই ধর্মে তারা দেবী নামে পরিচিত। এই তারা দেবীরই ভিন্ন রূপ নীল সরস্বতী। সেই অর্থে তারাপীঠ মূলত বৌদ্ধ দেবী। বিষ্ণুর দশবতারে যেমন নবম অবতার হিসেবে বুদ্ধদেবের স্থান হয়েছে। তেমন দশ মহাবিদ্যাতে তারাদেবীকে স্থান দেওয়া হয়েছে।
সুতরাং বৈদিক যুগে যে দেবী প্রজননের দেবী হিসেবে পরিচিত ছিলেন পরে যিনি সূর্যের প্রতীক হিসেবে জ্যোতি অর্থাৎ আলো ,আলো থেকে জ্ঞান দেবী বিদ্যার দেবী তে বদলে গেছেন ।
দেবীর রূপ ও বাহন নিয়েও নানা মত দেখা গেছে ।
সরস্বতী দেবীর ষোড়শ রূপের কথা বলা হয়েছে।
প্রথম রূপ রোহিণী। এই দেবীর বাহন জলচৌকি। চতুর্ভূজা। ডান ও বাম হাতে চক্র। অন্য দুটি হাতে বরাভয় মুদ্রা। দেবীর এই রূপের আরেক নাম অজিত বলা।
অবতার ২: প্রজ্ঞপ্তি ,বাহন হাঁস। ষষ্ঠ ভূজা। দুটি হাতে বরাভয়। অন্য চার হাতে অসি, কুঠার, চন্দ্রহাস দর্পণ। এই দেবীর অপর নাম দুরিতারী। দেবীর হাতে দর্পণ কিন্তু প্রসাধনের জন্য নয়, পৌরাণিক যুগে দর্পণ ব্যবহৃত হতো সূর্যের প্রতিবিম্ব প্রতিফলিত করে শত্রুর চোখে আলো ফেলে তাকে মুহূর্তের জন্য অন্ধ করে দিতে। যাতে শত্রুর যুদ্ধে মনোসংযোগ বিঘ্নিত করা যায়। আবার রথে লুকিং গ্লাস রাখলে পিছনের শত্রুকে দেখা যায়। দেবীর তৃতীয় রূপ বজ্র শৃঙ্খলা। বাহন হাঁস। চতুর্ভূজ। দুহাতে বরাভয়। অন্য দুটি হাতে পরিখ ও বৈষবাস্ত্র। পরিখ হল গদাকৃতি কিন্তু তাতে কাঁটা বসানো। দ্বিতীয় অস্ত্রটির মালিক শ্রী কৃষ্ণ। এই অস্ত্রে অবধ্য কেউ নয়। চতুর্থ রূপ কুলি শাঙ্কুশা।বাহন ঘোড়া। চতুর্ভূজা। দুটি হাতে বরাভয়। অন্য দুটি হাতে অসি ও ভুষণ্ডি। দেবীর অন্য নাম মনোবেগা, মনোগুপ্তি শ্যামা। চক্রেশ্বরি দেবীর পঞ্চম রূপ। বাহন গরুড়।১৬ হাত। দশ হাত মুষ্টিবদ্ধ, দুহাত কোলে তপস্বার ভঙ্গী, দুহাতে বরদান এবং দুই হাতে অসি ও ভুষণ্ডী। অর্থাৎ গুলতি ধরণের অস্ত্র।
———————শেষাংশ আগামীকাল————-
Be First to Comment