#শুভ জন্মদিন তুলসী চক্রবর্তী#
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বাংলাদেশ ৩মার্চ ২০২০। বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগ যে, ‘স্বর্ণময়’ হয়ে উঠতে পেরেছিল তার অন্যতম কারণ তুলসী চক্রবর্তীর মতো অভিনেতারা ছিলেন বলে। ‘সাড়ে ৭৪’-এ তুলসী বাবু আর মলিনা দেবীকে ছেড়ে যেন উত্তম-সুচিত্রার দিকে চোখই যায়না। বাংলা সিচুয়েশন কমেডির ভাণ্ডার একেবারে শূন্য নয়, কিছু কিছু রত্ন সেখানে রয়েছে, যেখানে তুলসী চক্রবর্তী একটি উল্কা রত্ন। ৩১৬টির মতো বাংলা ছবিতে অভিনয় করেছিলেন তিনি। কোথাও নামমাত্র সম্মানী, কোথাও বা সবিনয় অনুরোধে কিংবা বিনে পারিশ্রমিকে অভিনয় করতেন এই অসাধারণ অভিনেতা। হাওড়ার শিবপুরে, নিজের বাড়ীতে ট্রাম ধরে ফিরে যেতেন স্যুটিং শেষে। টাক মাথা, ধুতি-হাফ ফতুয়া পরা এই ভদ্রলোক পৌরহিত্য করতেন টাকার জন্য। তুলসীবাবুর বাবা আশুতোষ চক্রবর্তী রেলে কাজ করতেন বলে, পড়াশোনার জন্য কাকা প্রসাদ চক্রবর্তীর কাছে থাকতেন তিনি। বাবার অকালমৃত্যুর পর মা নিস্তারিণী দেবীকে নিয়ে কলকাতায় এসে তার প্রথম লক্ষ্যই ছিল একটা চাকরী পাওয়া। ভাল গান গাইতে পারতেন, বিশেষ করে কীর্তনাঙ্গের গান। গিরিশ পার্কের পার্বতী ঘোষ লেনের ব্যায়ামাগারে নিয়মিত ব্যায়াম ও শরীরচর্চাও করতেন।
কাকার অর্কেষ্ট্রা পার্টির গ্রুপ ছিল। কলকাতার ধনীদের বাড়িতে নানা অনুষ্ঠানে তার দল নাটক করত। তুলসী চক্রবর্তীও সে দলে যোগ দিয়ে কীর্তন ও শ্যামা সঙ্গীত গাইতেন। পরে কাকা স্টার থিয়েটারে যোগ দিলে কলকাতার রাস্তায় ঘুরতে ঘুরতে চিৎপুরের এক মদের দোকানে বয়ের কাজ জোটালেন। কাকা খবর পেলে কাজ ছাড়তে হল। এরপর কাজ নিলেন ঘড়ি সারাইয়ের দোকানে। সেখানে বেশিদিন মন টিকল না। বাড়ি থেকে পালিয়ে বর্মা গেলেন। যে জাহাজে পালালেন সেটিতে ‘বোসেস সার্কাস পার্টি’ও চলেছিল। সেখানেই চাকরি নিলেন। মাঝে মধ্যে শো-এর ফাঁকে জোকারও সাজতেন। এভাবেই তিনি হাস্য-কৌতুকের প্রতি ঝুকে পড়েন। তুলসী চক্রবর্তী সার্কাসে থেকে কিছু খেলা যেমন শিখলেন তেমনি শিখলেন উর্দু ও হিন্দী বলতে। সার্কাসে তিনি মাস ছয়েক ছিলেন। চলে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলতেন— ‘শরীর থেকে জন্তু-জানোয়ারের গন্ধ বেরুচ্ছে দেখে চলে এলুম।’কাকা তখন ছাপাখানায় কম্পোজিটরের কাজ জুটিয়ে দিলেন। সেখানে থিয়েটারের হ্যান্ডবিল ও পোস্টার ছাপা হত।
তা দেখে তাঁর অভিনেতা হতে ইচ্ছে করল। জ্যাঠামশায়কে অনেক অনুরোধ করায় তিনি স্টার থিয়েটারে অপরেশ মুখোপাধ্যায়ের সাহায্যে ঢোকালেন। তৎকালীন ষ্টার থিয়েটারের মালিক ছিলেন অপরেশ মুখোপাধ্যায়। মাত্র ১৭ বছর বয়সেই চোখে পড়ে যান অপরেশবাবুর। সালটা ছিল ১৯১৬। এই অপরেশবাবুই তালিম দেন তুলসী চক্রবর্তীকে। টপ্পা গান, পাখোয়াজ বাজানো— সব শিখেছিলেন। ধীরে ধীরে তিনি ‘থেটার’ করার সুযোগও পেলেন। ১৯২০ সালে প্রথম স্টেজে অভিনয় করেন। নাটকের নাম ছিল ‘দুর্গেশনন্দিনী’। শেষ নাটক ছিল— ‘শ্রেয়সী’ (১৯৬০)। তারপর তার শারীরিক অসুস্থতার জন্য (হৃদযন্ত্র) আর মঞ্চে অভিনয় করেননি। তুলসী চক্রবর্তীর সিনেমা শুরু ১৯৩২ সালে, নিউ থিয়েটারের ‘পুণর্জন্ম’ সিনেমায়।
পরিচালক ছিলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী। তার শেষ সিনেমা মৃত্যুর আঠারো বছর পর মুক্তি পায় ১৯৭৯ সালে— ‘আমি রতন’। ১১ ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে হঠাৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান এই অভিনেতা। পয়সাও ছিল না চিকিৎসার জন্য। প্রচণ্ড দারিদ্রতা তো ছিলই, তার ওপরে নিজের বাড়ীটা দান করেছিলেন এলাকার দরিদ্র পুরোহিতদের জন্য। স্ত্রী উষারাণী দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন একমুঠো খাবারের জন্য। অ্যান্ড্রু রবিনসন ‘পরশপাথর’-এ তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয় সম্পর্কে বলেছিলেন— ‘Chakravarty recalls Chaplin to his best. Instead of moustache, he has a pair of eyes as bulbous as a frog’s which he opens wide with every emotion known to man.’
সত্যজিৎ রায়ের কাছে তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন ‘ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র’।
তুলসী চক্রবর্তী ১৮৯৯ সালের আজকের দিনে (৩ মার্চ) পশ্চিমবঙ্গের কৃষ্ণনগরের গোয়ারী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment