স্মরণঃ সু ধী ন দা শ গু প্ত
বাবলু ভট্টাচার্য : তিনি ‘সুধীন দাশগুপ্ত’ না হয়ে উঠলে ‘প্রকাশ পাড়ুকোন’ হতে পারতেন— শুনলে আজ হয়তো লোকে হাসবে। কিন্তু দার্জিলিংবাসী ধনী পিতার সন্তানটি শুধু যে ঘরে বসে বেহালা-পিয়ানো-ম্যান্ডোলিনে স্বশিক্ষিত হয়ে উঠেছিলেন তা-ই নয়, র্যাকেট হাতে কোর্টও কাঁপাতেন।
তিনবারের রাজ্য ব্যাডমিন্টন চ্যাম্পিয়ন! কিন্তু ভাগ্যিস তরুণ সুধীন কর্ক রেখে হাতে ছড় তুলে নিয়েছিলেন, নাহলে থৈ থৈ শাওন আর আসত কি?
১৯২৯ সালের ৯ অক্টোবর সুধীন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত দার্জিলিং -এ জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
ছেলের সঙ্গীতে আগ্রহ দেখে পিতৃদেব পাঠিয়ে দিলেন লন্ডনের রয়াল মিউজিক স্কুলে। সেখান থেকে পোস্ট- গ্রাজুয়েশন করে সুধীন বম্বে নয়, নলিন সরকার স্ট্রিটের এচএমভি’র দফতরে এসে গেলেন, কমল দাশগুপ্তের সাকরেদি নিয়ে। ভাগ্যিস এসেছিলেন, নাহলে শেষ বিচারের আশায় বসেই থাকতে হত।
শুধু পাশ্চাত্য-সঙ্গীতের শিক্ষাই নয়, এনায়েত খানের কাছে সেতার শিক্ষা, রীতিমত ভাতখণ্ডে-চর্চা ভারতীয় মার্গ-সঙ্গীতে। দেশি-বিদেশি লোকসঙ্গীতের অপার ভাণ্ডার তাঁর হেফাজতে ছিল, ছিল কীর্তনাঙ্গ গানও— যার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে ‘শ্যামও আজ বদলে গেছে’ (সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়) বা ‘ও শ্যাম যখন তখন’ (আরতি মুখার্জী)-র মত গানে। এমনকি ছোটদের জন্যেও ‘হিংসুটে দৈত্য’ বা ‘ছোটদের রামায়ণ’-এ কী অসাধারণ সুর দিয়ে গেছেন সুধীনবাবু!
আরতির মুখোপাধ্যায়ের গলার সেই অনবদ্য গান? হ্যাঁ, গানখানির গীতিকারও ছিলেন সুধীনবাবু। আর, অন্ততঃ এই একটি নিরিখে উনি আর আর সব সুরকারকে পেছনে ফেলে দেবেন— ‘জীবনে কি পাবো না’ অথবা ‘হয়তো তোমারই জন্য’ বা ‘এতো সুর আর এতো গান’-এর মত গীতমালা আর কোনো সুরকার লিখে যেতে পারেননি। পেনে ও পিয়ানোয় সমান দক্ষ ছিলেন। কিন্তু গীতিকার সুধীন চাপা পড়ে গেছে সুরকার সুধীনে।
‘ছদ্মবেশী’ চলচ্চিত্রে অনবদ্য মুখভঙ্গিমায়, খোঁড়ানো উত্তমকুমারের লিপে মান্না দে-র সেই জমাটি গান— ‘সেই গলিতেই ঢুকতে গিয়ে হোচট খেয়ে দেখি/বন্ধু সেজে বিপদ আমার দাঁড়িয়ে আছে একি!’
অথবা আরেক কিংবদন্তি নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের সদলবলে টুইস্ট নাচের সঙ্গে মান্না দে’র গাওয়া আর এক নতুন ধারার গান— ‘জীবনে কি পাবনা/ভুলেছি সে ভাবনা/সামনে যা দেখি/জানিনা সে কি/আসল কি নকল সোনা!’
এই গানগুলির সুরকার এবং গীতিকার সুধীন দাশগুপ্ত। দুটি গানই কিন্তু আজও তুমুল জনপ্রিয়। এমনকি নতুন প্রজন্মের কাছেও এদের বেশ একটা অন্য আকর্ষণ রয়ে গেছে। আসলে একই স্রষ্টার হাতে সুর আর কথার সঠিক যুগলবন্দী সম্ভবতঃ এক অন্য মাত্রা নেয়।
যতীন্দ্রমোহন বাগচীর লেখা সেই বিখ্যাত কবিতাটিতে অনবদ্য সুরারোপ করেছিলেন— ‘বাঁশ বাগানের মাথার ওপর চাঁদ উঠেছে ঐ/মাগো আমার শোলোক বলা কাজলা দিদি কই!’
যৌবনের অস্থিরতা, উদ্দামতা-উদ্দীপনা বা প্রেমের গাঢ়তা এবং চাপল্য, জীবনের বিষন্নতা বা আনন্দ, সবকিছুই তিনি খুব সুন্দরভাবেই তুলে ধরতে পেরেছেন। একথা মনে রাখতে হবে এই সবই তিনি করে ফেলেছেন তথাকথিত বাণিজ্যিক ছবিতে যেখানে কিন্তু পরীক্ষা করার অবকাশ খুবই কম।
কিন্তু সেখানে তিনি ভীষণভাবেই সার্থক, এমনকি একযোগে গীতিকার ও সুরকার রূপে বাংলা চলচ্চিত্রে তাঁকে সবচেয়ে সফল স্রষ্টা বললে হয়তো অত্যুক্তি করা হবে না। আজকের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেই গানগুলির জনপ্রিয়তা তাই প্রমাণ করে।
সুধীন দাশগুপ্ত ১৯৮২ সালের আজকের দিনে (১০ জানু) কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।
Be First to Comment