জন্মদিনের শুভেচ্ছাঃ হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, বহু যুগের কুসংস্কার আর ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে বদ্ধ, জীর্ণ এই সমাজে তিনি ঝড় তুলেছিলেন। জন্ম সূত্রে বাঙালি না হয়েও বাঙালিদের সঙ্গে মনে প্রাণে জড়িয়ে ছিলেন তিনি। তিনি ঊনিশ শতকের বাংলার নবজাগরণের এক অবিস্মরণীয় নাম হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও। তার বাবার নাম ফ্রান্সিস। মা সোফিয়া। মাত্র ছ’বছর বয়সে মাতৃহারা হয়েছিলেন হেনরি। পরে তার বাবা আনা মারিয়া নামে এক ইংরেজ মহিলাকে বিয়ে করেন। শোনা যায়, হেনরি বেশ সচ্ছল পরিবারে জন্মেছিলেন। পোশাকে কিংবা সাজসজ্জায় তিনি সব সময়ে পরিপাটি থাকতেন। মাথার মাঝখানে সিঁথি, সচরাচর টুপি পরতেন না। এটাই তার পরিচিত ছবি। শীতকালে ময়দানে ক্রিকেট খেলতেন বন্ধুদের সঙ্গে। আর ছিল ঘোড়ায় চড়ার শখ। হেনরির ব্যক্তিত্ব গঠনে বিশেষ ভূমিকা ছিল তার শিক্ষক ডেভিড ড্রামন্ডের। জীবনের ছয় থেকে ১৪ বছর পর্যন্ত হেনরি ড্রামন্ডের স্কুলে পড়েছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ডিরোজিও শিক্ষা জীবন শেষ করে উচ্চতর বিদ্যার্জনে না গিয়ে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন। ডিরোজিও মাত্র সতেরো বছর বয়সে শিক্ষকতা শুরু করেছিলেন। ছাত্রদের সঙ্গে তার বয়সের ব্যবধান ছিল খুব কম। কেউ কেউ ছিলেন তার সমবয়সী। তার প্রত্যক্ষ ছাত্রদের মধ্যে ছিলেন দক্ষিণারঞ্জন মুখোপাধ্যায়, রামগোপাল ঘোষ, প্যারীচাঁদ মিত্র, রাধানাথ শিকদার, রামতনু লাহিড়ী, শিবচন্দ্র দেব, দিগম্বর মিত্র, গোবিন্দচন্দ্র বসাক। তেমনই হরচন্দ্র ঘোষ, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ও রশিককৃষ্ণ মল্লিক ছিলেন তার ভাবশিষ্য। তবে শিক্ষাদানকে ডিরোজিও কেবল মাত্র ক্লাসরুমের মধ্যে আবদ্ধ করে রাখেননি। ক্লাসের বাইরে তার বাড়িতে কিংবা অন্যত্র তারা মিলিত হতেন। তাই তিনি হয়ে উঠেছিলেন ছাত্রদের friend philosopher and guide। ডিরোজিও’র এই সব ছাত্র ‘নব্যবঙ্গ’ বা ‘ইয়ং বেঙ্গল’ নামে পরিচিত ছিলেন। ১৮৩০ সালে অ্যালেকজান্ডার ডাফ আয়োজিত বক্তৃতামালার প্রথম অধিবেশনের পরে থেকেই হিন্দুসমাজে প্রচণ্ড বিক্ষোভ শুরু হয়। এর পরেই হিন্দু কলেজের অভিভাবকরা কর্তৃপক্ষের কাছে নালিশ জানিয়ে ছিলেন। কলেজের পরিচালন সমিতির বিশিষ্ট সদস্যরা কলেজে এক বিশেষ সভায় মিলিত হয়েছিলেন। কিন্তু তাতে দেখা গেল উপস্থিত ব্যক্তিরা ডিরোজিও’র শিক্ষার কুফল বিষয়ে নিশ্চিত নন। তাই একটি প্রস্তাব রাখা হলো জনসাধারণের বর্তমান মনোভাব বিবেচনা করে ডিরোজিওকে বরখাস্ত করা সময়োচিত কিনা। হিন্দু কলেজে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিলেও থেমে যায়নি তার জীবনসংগ্রাম। এ সবের মাঝেই চলতে লাগলো ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ পত্রিকা সম্পাদনার কাজ। থেমে যায়নি ধর্মান্ধতা, অন্ধবিশ্বাস আর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তার লেখালেখি। কিন্তু পত্রিকার ব্যয়ভার বহন করা সহজ ব্যাপার ছিল না। এর জন্য হেনরি একে একে বিক্রি করে দিয়েছিলেন নিজের লাইব্রেরির সব বইপত্র এবং দামী আসবাবপত্র। শেষের দিনগুলিতে তাকে পড়তে হয়েছিল নিদারুণ অর্থাভাবে।
১৮৩১-এর ১৭ ডিসেম্বর ডিরোজিও ধর্মতলা অ্যাকাডেমিতে পরীক্ষা নিতে গিয়েছিলেন। সে দিনই তিনি কলেরায় আক্রান্ত হন। সে সময় রোগটি ছিল দুরারোগ্য। ২৬ ডিসেম্বর তার মৃত্যু হয়। সাউথ পার্কস্ট্রিট সিমেট্রিতে তাকে সমাহিত করা হয়।
হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও ১৮০৯ সালের আজকের দিনে (১৮ এপ্রিল) কলকাতার মৌলালি অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment