———জন্মদিনে স্মরণঃ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ———
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, তবলা, পাখোয়াজ, ঢোল, খোল থেকে হারমোনিয়ম, পিয়ানো, বেহালা, অর্গ্যান, গিটার, ক্ল্যারিওনেট বাজানোয় সাবলীল সেই মানুষটি দেশের সঙ্গীতজগতের অন্যতম নক্ষত্র। সঙ্গীত সৃষ্টির পাশাপাশি সঙ্গীতের শিক্ষক হিসেবেও বরেণ্য। তিনি আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ। এমএ পরীক্ষা দেয়ার আগে হঠাৎ একদিন হকি খেলে বাড়ি ফেরার পথে ডান চোখে কেমন যেন ঝাপসা দেখলেন জ্ঞানপ্রকাশ। ডাক্তার দেখে জানালেন, রেটিনায় রক্তক্ষরণ। ফলে ২১ বছরের জ্ঞানপ্রকাশের আর এমএ পরীক্ষা দেয়া হল না। ঘুরে গেল জীবনের মোড়। সঙ্গীতকেই জীবনের মোক্ষ করে নতুন ভাবে পথ চলা শুরু হল জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের। বাবা কিরণচন্দ্র ঘোষ, মা নলিনীদেবী। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে জ্ঞানপ্রকাশই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। গানবাজনা, খেলাধুলো, অভিনয়, বাজি পোড়ানো সবেতেই ছিল ভীষণ উৎসাহ। পড়তেন খ্রিস্টান মিশনারি স্কুল ‘কলিনস ইনস্টিটিউট’-এ।
ঠাকুরদাদা দ্বারকানাথ ঘোষ ছিলেন হারমোনিয়মের ভারতীয় সংস্করণের স্রষ্টা। তাঁর হারমোনিয়ম প্রস্তুতকারক সংস্থার নাম ‘ডোয়ার্কিন অ্যান্ড সন্স’। সেখানে হারমোনিয়ামের পাশাপাশি বিক্রি হত ক্ল্যারিওনেট, কর্নেট প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র। বাড়ির পিয়ানো অর্গ্যানের পাশাপাশি সেই সব যন্ত্রতেও হাত পাকাতেন ছোট জ্ঞানপ্রকাশ। পরিবারের সদস্যেরা মিলে অর্কেস্ট্রা তৈরি করেছিলেন। ম্যাট্রিকুলেশনে পালি ভাষায় ‘লেটার’ পেলেন। ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে। এর মধ্যেই প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ পাশ করলেন। এমএ-তে ভর্তি হলেন বিশ্ববিদ্যলয়ে। এর পাশাপাশি বাবা কিরণচন্দ্রের আগ্রহে আইন পড়াও শুরু করেন তিনি। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বিশ্বাস করতেন, ভাল যা কিছু নিজের ভেতর গ্রহণ করা হয় তার পুরোটাই শিক্ষা। তাই বাড়ির আসরে যখন বড়ে গোলাম আলি বা আমির খান সঙ্গীত পরিবেশন করতেন, তখন একনিষ্ঠ ছাত্রের মতো শিখতেন জ্ঞানপ্রকাশ। শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পুরো তালিম ছিল জ্ঞানপ্রকাশের। ভারতে যতগুলি তালবাদ্য পাওয়া যায় তার সব ক’টি নিয়ে একটি অর্কেস্ট্রা সৃষ্টি করেছিলেন। নাম দিলেন ‘ড্রামস অফ ইন্ডিয়া’। ষাটের দশকের শেষে সেটি এইচএমভি থেকে রেকর্ড হয়ে বেরোয়। সারা পৃথিবীতে এই রেকর্ড ভীষণ জনপ্রিয় হয়েছিল। অস্ট্রেলীয় সরকার সেই রেকর্ডের ১০ হাজার এলপি এইচএমভি কোম্পানির কাছে অর্ডার দিয়েছিল।
কী ছিল না সেই তালবাদ্যের তালিকায়— ঢোল, খোল, নাল, নাকাড়া, পাখোয়াজ, ঢাক, তবলা, মৃদঙ্গ প্রভৃতি। বাংলা এবং হিন্দি ভাষার অসংখ্য চলচ্চিত্রে তিনি সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। সমস্ত ছবিই সেই আমলে ভীষণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল— ‘বিচার’, ‘বসন্তবাহার’, ‘যদু ভট্ট’, ‘রাজলক্ষ্মী ও শ্রীকান্ত’, ‘আঁধারে আলো’ ইত্যাদি। তাঁর সুরে গান গেয়েছেন বড়ে গোলাম আলি খান, আমির খান, বিলায়েত খান থেকে শুরু করে মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনেক শিল্পী গান তুলতেও আসতেন তাঁর কাছে। তার মধ্যে উল্লেখ্য কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, সুমিত্রা সেন প্রমুখ। জ্ঞানপ্রকাশের সুরে পঞ্চাশের দশকে দু’টি ভজন রেকর্ড করেছিলেন কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯৪১-’৪২ সাল নাগাদ জ্ঞানপ্রকাশ তখনকার বোম্বেতে পাড়ি দিলেন। এই সময়ে তিনি হিন্দি ছবি ‘পরায়া ধন’-এ অভিনয় করেন। ছবিটির সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন জ্ঞানপ্রকাশ। দক্ষিণ ভারতের বালমুরলী কৃষ্ণ এবং জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ছিলেন আকাশবাণীর প্রথম সঙ্গীত প্রযোজক। এই পদে তিনি প্রায় ১৫ বছর কাজ করেছেন। আকাশবাণীর কাজ করতে গিয়ে নিত্যনতুন সঙ্গীতের উদ্ভাবনও করতেন জ্ঞানপ্রকাশ। সঙ্গীতকার হিসেবে প্রায় সারা পৃথিবী ঘুরেছেন। জাপানে এবং রাশিয়ায় ভারতের হয়ে জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ প্রতিনিধিত্ব করেছেন কয়েকটি অনুষ্ঠানে। এ ছাড়া মার্কিন মুলুকের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাও করেছেন প্রায় ৫ বছর। সানফ্রান্সিসকো স্টেট ইউনিভার্সিটি, বার্কলে বিশ্ববিদ্যালয়, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং পেনসিলভেনিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি সঙ্গীত বিষয়ক শিক্ষক ছিলেন।
হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন জ্ঞানপ্রকাশ। ৮৪ বছর বয়সে ১৯৯৭-এর ১৮ ফেব্রুয়ারিতে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।
আচার্য জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ ১৯১৩ সালের আজকের দিনে (৯ মে) কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment