—জন্মদিনের শ্রদ্ধাঃ হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়–
বাবলু ভট্টাচার্য: ঢাকা, এ রকমই আশ্চর্য উদ্ভট ভাষায় মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলত বরফি, ‘গুগাবাবা’-র সেই বিখ্যাত জাদুকর৷ আর ‘বরফি’-র চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন যিনি, সেই হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়ও কম আকর্ষণীয় ছিলেন না৷ অভিনয়ের পাশাপাশি কবিতা লিখেছেন, আবার প্রথম লোকসভার সাংসদও হয়েছিলেন৷ বাম মতাদর্শে বিশ্বাসী হলেও তাঁর মাতৃসমা বড়দি সরোজিনী নাইডু আবার ছিলেন কংগ্রেস- অন্ত প্রাণ৷ হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় বাম মতবাদে বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভায় তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন৷
জিতেছিলেন তখনকার মাদ্রাজ রাজ্যের বিজয়ওয়াড়া কেন্দ্র থেকে৷ ১৯৫৭ সাল পর্যন্ত সাংসদ ছিলেন৷ নির্দল প্রার্থী হিসাবে জিতলেও তাঁকে সমর্থন করেছিল তখনকার অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টি৷ অথচ তাঁর প্রায় মাতৃসমা বড় দিদি ছিলেন সরোজিনী নাইডু৷ ভাই-বোনের অনেক মিল, কিন্ত্ত রাজনীতিতে দুই মেরুর বাসিন্দা৷ হরীন্দ্রনাথের পিতা অঘোরনাথ চট্টোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম ডি.এস.সি। জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা কমিউনিস্ট বিপ্লবী বীরেন চট্টোপাধ্যায় এবং বোন দেশনেত্রী সরোজিনী নাইডু।
হরীন্দ্রনাথ বাল্যবিধবা কৃষ্ণা রাওকে বিয়ে করেন, পরবর্তীকালে যিনি সমাজসেবিকা কমলাদেবী চট্টোপাধ্যায় নামে খ্যাত হয়েছিলেন।হরীন্দ্রনাথ বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। মাত্র ১০ বছর বয়েসে ক্ষুদিরামের ফাঁসির প্রেক্ষিতে ইংরেজি কবিতা ‘ডাইং পেট্রিয়ট’ রচনা করেন। উচ্চশিক্ষার জন্যে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যান, সেসময় কেম্ব্রিজে নিয়ম ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি না থাকলেও মেধা প্রমাণিত হলে ডক্টরেট ডিগ্রির গবেষণার অনুমতি দেওয়া হবে। প্রতিভাবান হরীন্দ্রনাথ তার ‘ফিস্ট অফ ইয়ুথ’ কাব্যগ্রন্থের জন্যে গবেষণার সুযোগ পান।গান্ধীজির অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। আন্দোলনের সময় তিনি হিন্দি ও ইংরেজি ভাষায় গীতিকার ও সংগীতশিল্পীর কাজ করেছেন।
‘শুরু হুই জং হামার’ গানটি গাইবার জন্যে ৬ মাস জেল হয়। গণনাট্য ও প্রগতি লেখক সংঘের সাথে গভীর যোগাযোগ থাকলেও তার সর্বজনপ্রিয়তা তাকে নির্দিষ্ট কমিটি বা দলে আটকে রাখেনি। জওহরলাল নেহ্রু তার প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। মূলত তারই প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত লোকসভা সদস্য হয়েছিলেন। উত্তপ্ত বাদানুবাদ ও রাজনৈতিক তর্কের সময় লোকসভায় তার অনাবিল হাস্য পরিহাস সর্বজনবিদিত। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সাথে তার বন্ধুত্ব ছিল, তাদের মধ্যে ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট সূকর্ণ অন্যতম। তার কবিতার প্রশংসা করেছিলেন স্বয়ং কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য ফিস্ট অফ ইউথ’। দেশ বিদেশের বহু পত্রিকায় তার লেখা প্রকাশিত হয়। দ্য কফিন, এনসিয়েন্ট উইং, ডার্ক ওয়েল, দ্য ডিভাইন ভ্যাগাবন্ড, ব্লাড অফ স্টোনস, স্প্রিং ইন উইন্টার, দ্য উইজার্ড মাস্ক, ফাইভ প্লেজ ইত্যাদি অজস্র রচনা রয়েছে ইংরেজি ভাষায়। বিখ্যাত ‘ইন্টারন্যাশনাল’ সংগীতের হিন্দি তর্জমা করেছেন, লিখেছেন সিনেমার প্রচুর গান। নিজেও সংগীতশিল্পী হিসেবে জনপ্রিয় ছিলেন। ১৯৪৪ সালে গণনাট্য কর্মীরা কলকাতায় তাকে দিয়ে একটি অনুষ্ঠান করায় সেখানে এককভাবে গান, হারমোনিয়াম বাদন, কবিতা আবৃত্তি করেন।বোম্বাইতে থাকাকালীন চিত্রপরিচালক হৃষিকেশ মুখার্জির সাথে ঘনিষ্ঠতা জন্মে। তার বহু ছবিতে অভিনয় করেছেন হরীন্দ্রনাথ।
হরীন্দ্রনাথ অভিনীত হিন্দি ছবিগুলি হলোঃ ‘আশীর্বাদ’, ‘সাহেব বিবি অউর গুলাম’, ‘রাত অউর দিন’, ‘তেরে ঘর কে সামনে’, ‘চল মুরারী হিরো বননে’, ‘বাবুর্চি’, ‘গৃহপ্রবেশ’ ইত্যাদি। ‘আজাদ’ নামে একটি ছবির প্রযোজনাও করেন তিনি। সত্যজিৎ রায়ের পরিচালনায় ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘সীমাবদ্ধ’, ‘সোনার কেল্লা’য় অভিনয় করেছেন। শেষোক্ত ছবিতে সিধু জ্যাঠার চরিত্রে বাঙালির কাছে তিনি বহুল পরিচিত। পদ্মভূষণ পুরস্কারে সম্মানিত হন হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়।
২৩ শে জুন, ১৯৯০ সালে মৃত্যু হয় তার।
হরীন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় ১৮৯৮ সালের আজকের দিনে (২ এপ্রিল) হায়দ্রাবাদে জন্মগ্রহণ করেন।
Be First to Comment