Press "Enter" to skip to content

গিরিশ চন্দ্র ঘোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মতিলাল রায় রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আর্শীবাদ লাভ করেন….।

Spread the love

” মতিলাল রায় ”
( ১৮৪৩ – ১৯০৯ )
—————————-
ডাঃ দীপালোক বন্দোপাধ্যায় : কলকাতা, ২৭ মে, ২০২৪। বাংলা আধুনিক যাত্রার পথিকৃত “মতিলাল রায় ”
১২৪৯ বঙ্গাব্দের ২১ মাঘ পূর্বস্থলীর ভাতশালা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন ৷ “যাত্রা” শব্দের আভিধানিক অর্থ দীর্ঘপথ অতিক্রম করা হলেও বাংলায় যাত্রা বলতে বোঝায় গান , নাচ , সংলাপ সহযোগে অভিনয় ৷ ষোড়শ শতকে সম্ভবত এর উদ্ভব ৷ জয়দেবের “গীতগোবিন্দম” ও বলা যেতে যাত্রা পালা ৷ এছাড়া এর নমুনা মেলে রামযাত্রা , কৃষ্ণ যাত্রা , চণ্ডীযাত্রা এসবে ৷ তবে, আসলে যাত্রা বাংলার থিয়েটারের রকমফের হলেও ধারে এবং অনেকখানি ভিন্ন ৷ উচ্চ শব্দ , চড়া আলোয় , বিশাল মঞ্চে অতিনাটকীয় ভাবভঙ্গীও আবৃত্তির সঙ্গে উপস্থাপনা ৷ মতিলালের আগে যাত্রা ছিল অশ্লীল খেউর ও আদিরসে ভরা ৷ তাই ভদ্র সমাজ ও মহিলারা যাত্রাপালা দেখা থেকে দূরে থাকতেন ৷ তিনি যাত্রাকে রুচিশীল লোক শিক্ষা ও মনোরঞ্জনের মাধ্যম হিসাবে সমগ্র বাঙালী সমাজের প্রিয় করে তোলেন ৷ হরিমোহন কর্মকার , গোবিন্দ অধিকারী , শিশুরাম অধিকারী , মদনমোহন চট্টোপাধ্যায় বা ব্রজমোহন রায়রা চেষ্টা করেও যাত্রার আঙ্গিকের বদল আনতে পারেন নি ৷ মতিলালের হাত ধরে যাত্রার মরা গাঙে জোয়ার আসে ৷ঘটে যাত্রার নবজাগরণ৷ যাত্রা অনেকটা থিয়েটারের আঙ্গিক পায় ৷ যাত্রার ব্যাপক উন্নতি ও রূপান্তরের ফলে বাংলার বাইরে আসমুদ্র হিমাচল বাংলা যাত্রার প্রসার ঘটে ! ঘনিষ্ঠ বন্ধু গিরিশচন্দ্র ঘোষের মত এইজন্য তিনি রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের আর্শীবাদ লাভ করেন ৷ আধুনিক যাত্রার প্রাণপুরুষ মতিলাল এক্ষেত্রে ছিলেন সব্যসাচী ও যুগান্তকারী প্রতিভার অধিকারী ৷ তিনি একাধারে অভিনেতা , পালাকার ,পরিচালক , গীতিকার সুরকার ও সুগায়ক ৷ তখন যাত্রাকে বলা হত গীতাভিনয় ৷ তিনি যাত্রাপালায় গদ্যে সংলাপ ও প্রচুর উপভোগ্য গান দেন ৷
মতিলালদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন রাজশাহী জেলার মানুষ ৷ সেখান থেকে বাস উঠিয়ে পিতা মনোহর রায় চৈতন্য ভূমি নবদ্বীপে আসেন ৷ সেখান থেকে মাত্র একমাস পরে চলে আসেন পার্শ্ববর্তী পূর্বস্থলীর সোনারুদ্র গ্রামে ৷ মনোহরবাবু কাছেই ভাতশালায় বাড়ী করে স্থিতু হন ৷ওখানে মতিলালের জন্ম হয় ও মনোহর বাবুর মৃত্যু হয় ৷ মতিবাবু গ্রামের পাঠশালার পাঠ শেষে নবদ্বীপ , বারাসাত ও কলকাতায় পড়াশুনা করে পূর্বস্থলীর চক- ব্রাহ্মণগড়িয়া ও নবদ্বীপ মিশনারী স্কুলে শিক্ষকতা করেন ৷ সেখানে ছিল মাসিক মাত্র ১৫ টাকা বেতন ৷ শিক্ষকতায় বেতন স্বল্পতার কারণে কলকাতার জোড়াসাঁকো পুলিশ থানায় ও পরে কলকাতা জিপিও -তে কাজ নেন ৷ মাত্র এগারো বছর বয়সে বালিতে মনমোহিনী দেবীকে বিয়ে করেছিলেন ৷
কিন্তু , ১২৭৬ বঙ্গাব্দে ছেলে ধর্মদাসের জন্মের কয়েক মাসের মধ্যে স্ত্রীর অকালপ্রয়াণে ৮০ টাকা বেতনের ডাকবিভাগের চাকরী ছেড়ে ভাতশালা গ্রামে ফিরে আসেন ৷ মানসিক জ্বালা ভুলতে এখানে সেখানে ঘুরতে ঘুরতে রায়দোগাছিয়া গ্রামে জমিদার হরিনারায়ণ রায়ের যাত্রা শুনে মুগ্ধ হন ৷ যাত্রা দেখার নেশা পেয়ে বসে ৷ তা দেখে কাকা হরিচরণ রায় তাঁকে হরিনারায়ণের যাত্রা দলে ভরতি করে দেন ৷ প্রতিভাবান
মতিলালের জন্য হরিনারায়ণবাবুর যাত্রাদল বিখ্যাত হয়ে ওঠে৷ শখের থেকে হয় পেশাদার যাত্রা অপেরা ৷তাঁর কাজে খুশী হয়ে হরিনারায়ণবাবু মালিকানার শেয়ার দেন ও পালা লেখান ৷ মতিলালের অভিনয় দক্ষতা , পালা রচনায় অভিনবত্ব ও সুমধুর কন্ঠের কারণে হরিনারায়ণ বাবুর দলের যাত্রাদল সর্বত্র জনপ্রিয় হয় ৷ এই সময় ঐ দলে মতিলালের লেখা ও অভিনীত “তরণী সেন বধ ” ও ” রামবিদায় ” যাত্রা দুটি বাংলার ঝড় তোলে ৷এরপর মতিলাল ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে
নবদ্বীপের বিশিষ্ট সংস্কৃতিমনা ব্যবসায়ী রত্নমণি কুন্ডুর আর্থিক সহায়তায় একক মালিকানায় নবদ্বীপে “নবদ্বীপ বঙ্গ গীতাভিনয় সম্প্রদায় ”
যাত্রাদল গড়ে তোলেন ৷যাত্রা করে তিনি লক্ষ লক্ষ টাকা আয় করেছিলেন ৷ যেকোন পালার প্রথম আসরটি করতেন নবদ্বীপের পোড়ামাকে পুজো দিয়ে পোড়ামাতলায় ৷তিনি ছিলেন ভগবান রামচন্দ্রের ভক্ত ৷ ওনার বাড়ীতে রামরাজার ধূমধাম করে পুজো হত ৷ তাতে হাজার হাজার দরিদ্র নারায়ণের সেবা ও প্রচুর দানধ্যান করতেন ৷ সেখানে বাংলার সব পেশাদার যাত্রাদলের পালা হত ৷বাংলার প্রতিটি রাজা ও জমিদার বাড়ীতে হতে থাকে তাঁর বিভিন্ন পালাগান ৷শুধু যাত্রা নয় তিনি সুন্দর কবিতা লিখতেন ৷ মুখে মুখে কবিতা ও গান রচনা করতে পারতেন ৷ ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর” – এ নিয়মিত তিনি কবিতা ও খবর লিখতেন ৷বর্ধমানের মহারাজ মহতাব চাঁদ ছিলেন তাঁর পৃষ্ঠপোষক ৷ রাজবাড়ীর নন্দোৎসবে যাত্রাপালা ছাড়াও কৃষ্ণকীর্তন ও শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন ৷ ব্রাহ্মসমাজের নেতা কেশবচন্দ্র সেনের বাড়ীতে তাঁর “নিমাই সন্ন্যাস “পালায় শ্রীধর চরিত্রের অভিনয় দেখে ঠাকুর রামকৃষ্ণ ভাবাবেগে আচ্ছন্ন হয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে মতি মতি বলে কাঁদতে থাকেন ৷ তাঁর লেখা আরো কিছু জনপ্রিয় যাত্রা হলো সীতাহরণ , বিজয়চণ্ডী , রামের বনবাস , অহল্যা উদ্ধার , মিত্রমিলন , রাবণ বধ ,কর্ণ বধ ,অশ্বমেধ যজ্ঞ , সীতাহরণ , লক্ষ্মণ ভোজন ,দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ , পাণ্ডব নির্বাসন ,নরকাসুর বধ , ঊমা সংবাদ , পারিজাত হরণ প্রভৃতি চল্লিশটির বেশী যাত্রা এবং হাজার খানেক গান ৷ তাঁর লেখা সংগীত সংকলন “গীতাবলী” আজও সুধী সমাজে আদৃত ৷৷তাঁর যাত্রা হিন্দু পুরাণ , রামায়ণ , মহাভারতকে সবার অন্তরে গেঁথে দেয় ৷তবে তিনি ধর্মীয় কাহিনী ছাড়াও ঐতিহাসিক এবং রাজনৈতিক বিষয় নিয়েও পালা লিখেছিলেন ৷বর্ধমানের জেলা জর্জ টেলার সাহেব ইংরেজ হলেও বাংলা বুঝতেন তাঁর “ভীষ্মের শরশয্যা ” যাত্রা দেখে আপ্লুত হয়ে সোনার পদক দিয়ে সম্মানিত করেন ৷ মানভূমের ( বর্তমান পুরুলিয়ার ) গড় পঞ্চকোটের রাজা নীলমণি সিং বাহাদূর ছিলেন তাঁর বিশেষ গুণমুগ্ধ ৷

মতিলালের নামে রাজ্যের একটি জেলার নাম দেন “মতিজেলা “! কোচবিহারের রাজা একবার মতিলাল যেতে না পারায় রাজবাড়ীর পালাগান বন্ধ করে দিয়েছিলেন ৷ এমনকি অবাঙালী মহিশূরের রাজা তাঁর পালা গানে বিমোহিত হয়ে শ্রদ্ধায় মতিলালের গলায় রাজ্যের নামাঙ্কিত সোনার পদক প্রদান করেছিলেন ৷ মতিলাল রাজকীয় ভঙ্গিমায় হাতির হাওদায় বা উঠের পিঠে চেপে বিশাল দলবল নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় যাত্রা করতে যেতেন ৷ যাত্রাদল হিসাবে অন্য দলের চেয়ে অন্তত এক টাকা বেশী নিতেন ৷তিনি ছিলেন জনতার চোখে মহানায়ক তাই পথে শত শত মানুষ শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে ফুল ছড়িয়ে তাঁর শোভাযাত্রাকে সংবর্ধনা জানাতেন ৷ তাঁর মত আমাদের এলাকায় জন্ম এই কিংবদন্তী পালাকারকে নিয়ে যাত্রার রমরমা কালে অনেকবার সাংবাদিক হিসাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় এসব কথা লিখেছি ৷সেসময় যাত্রার রমরমা , অর্থ ও জনপ্রিয়তার জন্য চলচ্চিত্রের ও থিয়েটারের নায়ক -নায়িকারাও অনেকে গ্রামে গঞ্জে ঘুরে ঘুরে অস্থায়ী মঞ্চে যাত্রা করেছেন ৷ টেলিভিশন এসে যা অনেক কমলেও বাংলায় এখনও লক্ষ লক্ষ যাত্রামোদী আছেন ৷ এখনও কলকাতার যাত্রাপাড়া চিৎপুরে মতিলাল রায়কে স্মরণ করা হয় ৷ ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায় , ব্রজেন্দ্রকুমার দে , , মন্মথ রায় , সুপ্রিয়া দেবী , অজিত ঘোষ , আশুতোষ ভট্টাচার্য , যোগেশচন্দ্র চৌধুরী প্রমুখ তাঁকে প্রণাম জানিয়েছেন ৷এখনও অনেকে বিভিন্ন সময়ে তাঁর জন্মভূমিতে এসে তাঁকে শ্রদ্ধা জানান ৷ সেখানে মন্ত্রীর উদ্যোগে ও স্থানীয় মানুষের প্রচেষ্টায় তৈরী হয়েছে শিল্পীর আবক্ষ মূর্তি ও মতিলাল রায় স্মৃতি যাত্রা মঞ্চ ৷ ১৩১৫ বঙ্গাব্দের ৪ পৌষ বারাণসীতে ৬৬ বছর বয়সে এই ধর্মপ্রাণ গুণী ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্বের মহাপ্রয়াণ ঘটে ৷ বরেণ্য মানুষটিকে জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম ৷

More from BooksMore posts in Books »
More from CultureMore posts in Culture »
More from InternationalMore posts in International »
More from Theater/DramaMore posts in Theater/Drama »
More from Writer/ LiteratureMore posts in Writer/ Literature »

Be First to Comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Mission News Theme by Compete Themes.