মধুমিতা শাস্ত্রী: ১৬ এপ্রিল ২০২০। খবরের কাগজ খুললে কিংবা টেলিভিশন অন করলেই বিভিন্ন চ্যানেলে সেলিব্রিটিরা এই লকডাউনের মধ্যে বাড়িতে বসে কী করছেন, কী খাচ্ছেন, কী ব্যায়াম করছেন, কী রান্না করছেন, কেমন করে সময় কাটাচ্ছেন এসবই ঢালাও করে প্রচার করা হচ্ছে দেখছি। এসব সেলিব্রিটিদের মধ্যে অনেকে আবার বিভিন্ন চ্যানেলে ‘স্টে হোম স্টে সেফ’ বলে জনতাকে উপদেশও দিচ্ছেন। কে কত টাকা দান করছেন তা নিয়েও সামাজিক সংযোগ মাধ্যমে প্রচার চলছে ফলাও করে। এই ডামাডোলের মধ্যে দাঁড়িয়ে সিনেমার হিরো হিরোইন আর ক্রিকেটারদের ভজনা করতে গিয়ে আমরা ভুলেই যাছি প্রকৃত নায়কোচিত বীরত্ব দেখাচ্ছেন কারা? আমি বলতে চাইছি যে, সারা বিশ্বে লক্ষ লক্ষ ডাক্তার, নার্স, স্বাস্থকর্মীরা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে নিরন্তর রোগীদের সেবা করে যাচ্ছেন কিংবা যেসব পুলিশকর্মীরা, সেনাবাহিনীর জওয়ানরা দিন রাত এক করে আমাদের সুরক্ষিত রাখতে নিজেদের কর্তব্য পালন করে যাচ্ছেন তাঁরাই কি প্রকৃত হিরো নয়? অথচ এঁদের এই নায়কোচিত লড়াইয়ের কথা কতটুকুই বা উঠে আসছে আমাদের সংবাদমাধ্যমে। এইসব ডাক্তার, নার্স, পুলিসকর্মীরা অনেকেই পরিবার পরিজনকে বাড়িতে রেখে দূরবর্তী কর্মস্থলে কাজ করে যাচ্ছেন দিনের পর দিন। সেই কর্মস্থলে অনেকেই হয়তো বাড়ির আরাম, নিরাপত্তা কিছুই পাচ্ছেন না। এই রিয়েল হিরোদের বাড়ির লোকজনই বা কীভাবে কাটাচ্ছেন সেটা জানার কোনো উপায় নেই।নার্সদিদির সেই ছোট্ট মেয়েটা, মাকে কাছে না পেয়ে সারা বাড়ি মাথায় তুলেছে। তাতেও এনারা কর্তব্যে অবিচল। দিনের পর দিন ডিউটির পর কোনও নার্সদিদি বাড়ি ফিরে দেখেন, বাড়িওয়ালা দরজায় তালা দিয়ে চলে গিয়েছেন। আমাদের মানবিকতা কোথায় হারিয়ে গেছে? এই যোদ্ধারা কাদের সুরক্ষার জন্য দিনের পর দিন আত্মত্যাগ করছেন। আমরা সবাই করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে অবগত।
আমাদের জীবন বাঁচতে গিয়ে যে ডাক্তারবাবুরা আক্রান্ত হন, জীবনের শেষ সময়টাতেও আপনজনকে কাছে পান না। খবরের শেষবারের মতো প্রিয়জনকে বিদায় দিতে হয় ভিডিও কলের মাধ্যমে। তাঁরা কি আমাদের প্রকৃত হিরো নন? লকডাউনে প্রাণপাত করে অন্যভাবে যাঁরা এই যুদ্ধে সামিল, সেই পুলিসকর্মীরা দেশের সঙ্কটকালে নিজেদের রক্ত দিয়ে কখনও বা গান গেয়ে নিজের ডিউটি করে যাচ্ছেন। আবার উপায়ান্তর না পেয়ে পথেই ক্ষুধা নিবৃত্তি করছেন। আমরা যেখানে ঘরে বসে প্রিয়জনদের পাশে থেকেও অতিষ্ঠ হয়ে উঠছি। সেখানে এঁদের কথা একবার ভাবুন। রাতের ঘুমটা পর্যন্ত পর্যাপ্ত হচ্ছে না। এমন অনেক পুলিশকর্মী আছেন যাঁরা মাইলের পর মাইল সাইকেল চালিয়ে কর্মক্ষেত্রে যাচ্ছেন। সাধারণ মানুষকে পরিষেবা দেওয়ার জন্য এঁদের খাওয়া, ঘুম ছুটেছে। করোনা সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতে এক আই পি এস অফিসার মাতৃত্বকালীন ছুটি ত্যাগ করে কাজে যোগ দিলেন। আসলে সমাজের জন্য তিনি নিজের কর্তব্য অস্বীকার করতে পারেননি। তাই একমাসের সদ্যজাতকে কোলে নিয়েই নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সমাজের চোখে এঁরাই আজ রিয়েল হিরো নন কি? কাজেই আমাদের উচিত এঁদের কথা বলা, এঁদের অনুসরণ করা। কোনও ক্রিকেট খেলোয়াড় বা ফিল্মস্টারকে নয়।
Be First to Comment